আমার পিরিতের আগুনে গো
জল দিলেও তো নিবে না।
প্রথমেতে দিলাম শাড়ি
শাড়ির নামটি উনি
অপর পৃষ্ঠে লেখা আছে
নব লক্ষ জুনি।
সাজিয়া পরিয়া কন্যা
শাড়ির পানে চায়
মন পছন্দ হয় না শাড়ি
দাসীরে পরায় গো।
জমিরনের মায়ের কিন্নর কণ্ঠের গীত এবার অসহ্য ঠেকে হাসুর কাছে। মনটা খুব আনচান করে, শরীরে জ্বর জ্বর ঠেকে। মুখ ফুটে বলতে পারে না। অবলা নারীর মুখে এতো কথা মানায় না। বিয়ের কনে চুপচাপ থেকে সাজ নেবে এটাই নিয়ম, কখনো কখনো বেদবাক্য। সব নারীর বাসররাত ভালোবাসাময় হয় না, কেউ কেউ বাসর রাতে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষিত হয়, চিৎকার করতে চেয়েও অনেকে চিৎকার করতে পারে না। অবলা নারীদের বাসর রাতে চিৎকার করাও অধর্ম। কে জানে, হয়তো বা তাতে স্রষ্টা নারাজ হন। স্রষ্টা নারাজ হবে ভেবেই হয়তো বা অবলা নারীরা শব্দহীন হয়ে পড়ে সেদিন। ধর্ষিত হয় শুধু আরেকজনের কামনাকে চরিতার্থ করার জন্য। কৃত্রিম ভালোবাসার কালোজল খসে পড়লে স্বামী যখন ওপাশ ফিরে ঘুমায়, নবপরিণীতা স্ত্রী হয়তো বা তখন অপরিচিত একটা ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষটির ছবি মনে এঁকে কেঁদে কেঁদে রাতের আকাশের বুকে অদৃশ্য কিছু মেঘ জমায়। কিন্তু সে মেঘের গর্জন কেউই শোনে না। কোনো এক বর্ষার রাতে সবাই যখন ঘুমে থাকে, তখন অঝর বৃষ্টিধারার সঙ্গে সে মেঘের বরফও গলে গলে পড়ে।
আচ্ছা, এই অনুভূতি কি তার নিখিলের জন্য? বাসর রাতে কি নিখিল তার মতের বিরুদ্ধে কিছু করতো? নাহ। মন বলে, নিখিল এ রকম করতো না। ও তো আমাকে ভালোবাসে। আচ্ছা, সে এত হতাশ হচ্ছে কেন? বাসররাতটা নিখিলের সঙ্গে হবে না এজন্য? না কি তার বাসররাতে অপরিচিত একটা মানুষ তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার শরীরে কামনার নখর বসিয়ে অনধিকার চর্চা করবে সেজন্য?
দিনকয়েক আগে দাদি একটা কাজের ছেলেকে বকেছিলেন, পুরুষ মানুষ কুত্তার জাত। মেয়েছেলে দেখলেই জিহ্বা বাইরাইয়া পড়ে। হারামজাদা পোলারে ছুত্রা দিয়া বাইড়া।
আচ্ছা, সে কেন এতটা নিশ্চিত হচ্ছে? বাসররাতে তার হবু স্বামী তো তাকে শারীরিক মিলনে বাধ্য নাও করতে পারে, আবার নিখিলের সঙ্গে বিয়ে হলে সেও তো তাকে বাধ্য করতে পারতো। তবে, সেটা হয়তো তার কাছে ভালোই ঠেকতো। আচ্ছা, বিয়ে মানে কি শুধুই শারীরিক চাহিদা? তবে তো পুরুষ-রমণী হলেই হলো, জাতপাত ভাবতে হয় কেন? শারীরিক সক্ষমতা কি ধর্মের ওপর নির্ভর করে? একজন পুরুষ কিভাবে আরেকজন নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়? মুসলমান হলে কি শুরুতে আল্লাহ-খোদার নাম নেয়? আর হিন্দু হলে কি ‘হরে কৃষ্ণ’ বলে শুরু করে? গা-গুলিয়ে আসে হাসুর। আর ভাবতে পারে না।
হাসুর বিদ্যাশিক্ষা খুব বেশি একটা না। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শেষ করার পর ভর্তি হয়েছিল সদরের একটা স্কুলে। প্রতিদিন পর্দাঘেরা রিকশা করে স্কুলে যেতো, টিংটং বেল তুলে রিকশা এগিয়ে চলতো বাতাস কেটে। বাতাসের সঙ্গে কখনো কখনো চালকের আসনে বসা নিখিলের গায়ের গন্ধ এসে লাগতো নাকে। বেশিরভাগ গর্তগুলো নিখিল এড়াতো খুব কায়দা করে। এত যত্ন করে রিকশা চালানো যায়, সেটা হাসু আগে জানতো না। স্কুলছুটির পর প্রতিদিন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো নিখিল আর সঙ্গে তার রিকশা। হাসুর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করতো অরি, কণা বা তানিয়াদের মতো স্কুলমাঠে গোল্লাছুট খেলতে। বা ব্যাডমিন্টন ব্যাট নিয়ে স্কুলের পেছনের মাঠটাতে কিছুক্ষণ লাফালাফি করতে। কিন্ত সেটা সম্ভব হতো না নিখিলের জন্য। খুব প্রভুভক্ত একজন চাকর নিখিল। হাসুর হালকা দুষ্টুমিতে চোখ রাঙাতো নিখিল, যেন সহৃদয় বাবার কাছে ছেলেমানুষিতে ধরা পড়ে গেছে কোনো শিশু। হাসু মনে মনে খুব রাগ হতো। সে কি একজন মানুষ না? তার কি খেলতে ইচ্ছে করতে পারে না? মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে বলে কি তাকে অন্তঃপুরেই কাটাতে হবে?
একদিন বহরপাড়ায় রিকশা ঢুকলে চোখ আটকে যায় হাসুর। অনেক বড় একটা খুঁটি বসানো হয়েছে স্থানীয় হাইস্কুল মাঠে। রঙবেরঙের ঝালর ঝুলছে তাতে। কানের পোকা নাড়িয়ে বাচ্চারা কী যেন একটাতে মুখ দিয়ে প্যাঁ-পোঁ শব্দ করছে। আর কয়েকজন ঘাড়ের ওপর গোলাপি সাদা মেঘের সারি নিয়ে ‘হাওয়াই মিঠাই’ বলে হাক দিতে দিতে খদ্দের খুঁজছে। ঝালমুড়ি, কচুরি, ফুচকা, চটপটি, হালিম, চানাচুর, কী বিক্রি হচ্ছে না সেখানে! ভিড় দেখে রিকশার গতি কমিয়ে আনে নিখিল। সেই সুযোগে হাসু রিকশা থেকে নামে। নেমেই ভোঁ দৌঁড়। রিকশা রেখে মেলায় ঢুকে নিখিল হাসুকে খুঁজতে থাকে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর হাসুকে খুঁজে পায় সে। তাও মাটি থেকে ফুটখানেক উঁচুতে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে পড়তে নাগরদোলায় দোল খাচ্ছে হাসু। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিখিল। এ রকম মায়াভরা মুখ যেকোনো পুরুষের হৃদয়ের অনুর্বর জমিতেও বোপিত ভালোবাসার বীজকে প্রস্ফুটিত করবে। খোলা চুলগুলো বাতাসে যেভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে, তাতে নিখিলের হিংসে হতে থাকে। সবাই কেন ওর চুলের মিষ্টি গন্ধ নেবে? এই কৃষ্ণ রেশমি মায়ায় ডুবে মরার জন্যই তো ওর জন্ম হয়েছে। ওর কালো চুল, ওর লাল ঠোঁট, জামার নিচে ফুটে ওঠা হালকা বৃন্তক পুষ্পদ্বয়, ওর পাঁজর, উরু, উরুসন্ধি, সব জায়গায় ভালোবাসাবাসির অধিকার কেবল তারই আছে। অন্য কারও নয়।
—নিখিল দা? আমাকে খুঁজে বের করলে কী করে?
হাসুর কণ্ঠে বাস্তবতায় ফেরত আসে নিখিল। এতক্ষণ কী না ভেবেছে সে। ছি! আপামনির মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর করতেও লজ্জা লাগে তার।
—কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ? এ রকম করছ কেন?
আগের প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করার আগেই আরও কয়েকটি প্রশ্ন এসে ওর মাথায় টোকা দেয়। উত্তর ভাবার সময় পায় না নিখিল। তার আগেই কপালে একটা কোমল হাতের ছোঁয়ায় অনুভূত প্রশান্তিতে চোখ বুজে আসে নিখিলের। হালকা ভালোবাসার ছোঁয়ায় অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে যেতে কোনোমতে রক্ষা পেয়েছিল সেদিন নিখিল।
সেদিন নিখিলের ঢুলুঢুলু চোখের দিকে তাকিয়ে হাসু বুঝেছিল, নিখিলের মনের ভেতর বন্দি কথাগুলোর অর্থ। ঠোঁটের কোণে একটা হাসি চেপে হালকা পায়ে হেঁটে রিকশায় উঠে বসে তাকিয়ে দেখেছিল, পেছনে নিখিল তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যেন আচমকা বজ্রপাতে ঝলসে যাওয়া সেগুন বা হিজল! মেলায় নিখিল আর হাসুর সঙ্গে সেদিন এ বাড়ির আরও দুজন উপস্থিত ছিলেন। ঠোঁটে ধরা সিগারেটে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে যেন নিখিলকেই পুড়ে ফেলতে চাইছিলেন মালেক বেপারী। হাসুর মায়ের একমাত্র ভাই মালেক বেপারী। ব্যবসায় সূত্রে বোনের শ্বশুরবাড়িতে তার আসা-যাওয়া। সেদিন গঞ্জ থেকে ফেরার সময় হাসুকে দৌঁড়ে মেলায় ঢুকতে দেখে মালেক বেপারী তার সাইকেল থেকে নেমে তাকে খুঁজতে থাকেন। অবশেষে নাগরদোলার কাছে খুঁজে পান হাসু আর নিখিলকে।
—হারামজাদি পিরিতি শুরু করছে! বেগানা বিধর্মী বেটারে সোহাগ করতাছে!
বিচ্ছিরি একটা শব্দ করে মাটিতে থুথু ফেলেন মালেক বেপারী। হনহন পায়ে রওনা দেন হাসুদের বাড়ির দিকে।
মোল্লা বাড়িতে নিখিল এসেছিল বছরখানেক আগে। তার বাবা মা মারা গেছে ওলাবিবির প্রকোপে। সে বছর ওলার কোপ থেকে কেউ রেহাই পায়নি। ওর মা’টা মারা গেলো, বাবাটা গেলো। বড় দাদাটাও দুদিন ভুগে একদিন ঘুমের ভেতরই মারা গেলো। এতজনের মৃতদেহের মাঝে সেদিন শুধু নিখিলই নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। দশ ঘর পরের মোল্লাবাড়ির দুটো নেড়ি কুকুর ঘরে ঢুকে সবার শরীর শুকে শুঁকে দেখছিল। ওর শরীরটা শুঁকে দেখে চিৎকার করতে করতে বের হয়ে যায় একজন। একটু পর পাশের বাড়ির নলিনী, বিধানদের নিয়ে আবার ঘরে ঢোকে। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে নিখিল। শরীরটাও ততদিনে আবার দাঁড়িয়ে যায়৷ একদিন শোনে, মোল্লাবাড়িতে কয়েকজন কামলা নেওয়া হবে গৃহস্থালি কাজ করার জন্য। সুযোগটা কাজে লাগায় নিখিল। কপর্দকশূন্য অবস্থায় এর থেকে বেশি ভালো সুযোগ আর আসবে না। মাস ফুরোলে অল্প হলেও কিছু খোরাকি পাওয়া যাবে। আধছেঁড়া কাঁথাটার মাঝে নিজের সমুদয় বৈষয়িক সম্পত্তি রেখে শক্ত করে একটা গেড়ো দিয়ে মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিখিল। মোল্লাবাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে হাতের বাম পাশে গোয়ালঘরের পাশের ঘরটার একটা চৌকিতে জায়গা হয় তার। হাতের বোঝা নামিয়ে কাজে লেগে পড়ে সেদিন থেকেই। সততা আর কর্মনিষ্ঠার কারণে মোল্লাবাড়ির কর্তার সুনজরে আসতে বেশিদিন সময় লাগেনি নিখিলের। বাড়ির ছোটো মেয়ে যখন সদরের স্কুলে পড়তে যাবে, তখন একটা সমস্যা হয়েছিল তার আসা-যাওয়া নিয়ে। মোল্লাসাহেব নিখিলকে নিয়ে সদরে গিয়ে একটা রিকশা কিনে নিয়ে আসলেন। মোল্লাবাড়ির মেয়ে সে রিকশায় করে স্কুলে যাবে বলে কথা। বাড়ির গৃহিণীদের নতুন শাড়ি জুড়ে একটা পর্দা বসানো হলো তাতে।
মোল্লাবাড়ির মেয়ের বিয়ে-সারা তল্লাটে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। সারা বাংলার লোক আসবে। অনেক কাজ। সকাল থেকেই হাড়ি বাসন মাজছে নিখিল। হাজার তিনেক মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। তার জন্য শহর থেকে ডেকোরেটর ভাড়া করে আনা হয়েছে৷ উপকরণের অনুপাতে তারা লোক দেয়নি। মোল্লাবাড়ির কামলারাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সারা বাড়িতে ব্যান্ড পার্টি, কনসার্ট উদ্দাম তালে হিন্দি গানের সুর তুলছে৷ বাড়ির অল্পবয়সী মেয়েরা হাতে মেহেদি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাতের বাসনটা রেখে কপালের ঘাম মোছে নিখিল। সবাই আল্লাহ-খোদার নাম নেওয়ার সময় ওপর দিকে তাকায়। আকাশটা কত বিশাল, তার চেয়েও বিশাল নাকি স্রষ্টা। এত বিশাল স্রষ্টার এত ক্ষুদ্র একটা মানুষের সঙ্গে কিসের বিরোধ? হাসু আর তার মধ্যে ঘটা ঘটনাগুলো কি মালেক বেপারীর চোখে না পড়লে খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? সেও তো হাসুর মতোই রক্তে-মাংসে গড়া একজন মানুষ৷ নাকি সনাতন ধর্মের অনুসারীদের রক্তে নীল বা সবুজ রক্ত প্রবাহিত হয়? বা কালো?
—ওই শালা মালোয়ান, আসমানের দিকে চায়া দেখস কী? কাম কর হারামজাদা!
______________________________________________
বুকের মাঝখানে এভাবে চেপে ধরে একটা জীবন খুব সহজে কাটিয়ে দিতে পারতো সে। নিজামউদ্দীন মোল্লা খেকিয়ে উঠলে তাল সামলিয়ে উঠে দাঁড়ায় নিখিল
______________________________________________
মালেক বেপারীর কথায় খেয়াল হয়, সামনে অনেক বাসনকোসন। নিজের শরীরের কটূ গন্ধে নিজেরই বমি আসতে থাকে। আচ্ছা, মালেক বেপারী ঘামলেও কি তার শরীরে বাজে গন্ধ হয়? মোল্লার? বা নিজামউদ্দীন বেপারীর? কাঁধের গামছাটা দিয়ে শরীরে জমে ওঠা ঘাম মোছে নিখিল।
শিবপুরের মোল্লা বাড়ি। সারা বাংলায় এই পরিবারের নামডাক আছে। এই বাড়ির সবার ছোট মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। মেহেদি করা পাকা দাড়িতে মেয়ের বাবা কানু মোল্লা সবাইকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। কাউকে কাউকে অকথ্য গালি দিচ্ছেন। তাতে কেউ কিছু মনে করছে না৷ মোল্লা-ব্রাহ্মণরা যা খুশি তাই করতে পারেন, ধর্মের শিকলে তাতে টান পড়ে না।
—শুনছেন, এদিকে আসেন একটু। কথা আছে। ভেতরবাড়ি থেকে ডাক পড়ায় মেজাজ বিগড়ায় কানু মোল্লার।
বাড়ির মেয়েছেলেদের গলা ইদানীং খুব লম্বা হয়ে গেছে। শাসন বিধি মানে না। আচ্ছা করে মাগীরে একদিন…বিড়বিড় করে ওঠেন কানু মোল্লা।
—সে তো নাই।
— কে নাই? ও কী? এই হাসুর মা, খুইল্লা কও। কাইন্দো না তো! কী হইছে?
হাসুর মা ফোঁফাতে থাকেন। কথা বের হয় না তার মুখ থেকে।
—মাগীর বেটি কানবি পরে। আগে কথা ক।
—তারে খুঁইজা পাইতাছি না। তার কক্ষেই ছিল। বললো শরীর ব্যারাম করতাছে, শুইয়া থাকবো। সিনান করার জন্য ডাকতে গেলাম, গিয়া দেখি সে ঘরে নাই।
—নিখিল হারামজাদাটা কই?
—সে তো আছেই। একটু আগে দেখলাম বাসন মাজে।
হাতের লাঠিটাতে এবার সত্যিই নিজের শরীরের ভরটা ছাড়তে হয় কানু মোল্লার। মাথার ভেতর হালকা করে একটা ঘূর্ণি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। পাশের গ্রামের চৌধুরী মির্জার বড়ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের কথা পাকা করেছিলেন কানু মোল্লা। চিরবৈরী এই মির্জা পরিবার আর মোল্লা পরিবারের মধ্যে এই সম্পর্কটা দুটো পরিস্থিতির যেকোনো একটির সৃষ্টি করতে পারে জেনেও কানু মোল্লা সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। মেয়ে মরলে মরবে, তবু তিনি ওই বিধর্মীর কাছে নিজের মেয়েকে তুলে দেবেন না। নামাজ কয় ওয়াক্ত, তা জানলেও কোন ওয়াক্তে কত রাকাত নামাজ, তা জানেন না কানু মোল্লা। তবে পাকা দাড়ি আর সাদা আলখেল্লাকে মুসলমানের অবশ্য পরিধেয় পোষাক বলে মনে করেন তিনি। গোঁফ ছোট করে দাড়ি রাখাটাও মুসলমানের ছেলের অবশ্য করণীয় আরেকটি কাজ; যার ব্যত্যয় ঘটাননি কানু মোল্লা। এ রকম ধার্মিক একজন মানুষের মেয়ে বিয়ের দিন বাড়ি থেকে উধাও। এ রকম কথা বাজারে রটলে নিজের কী পরিস্থিতি হবে, তা ভেবেই মাথা চক্কর দিতে থাকে কানু মোল্লার।
গায়ের গোরখুঁড়োদের মধ্যে নিবাস মাঝির একটা নামডাক আছে। এই দুনিয়াটা বড়ই আজিব। যে শেখের বেটারা কোরআন হাদিস দেখিয়ে হিন্দুদের ধুর ধুর করে তাদেরই শেষ সম্পত্তির ওপর ঘর বানিয়ে দিতে হয় আমার। বিড়বিড় করতে করতে আশেপাশে তাকিয়ে কোমরের গোছা থেকে একটা বিড়ি বের করে সে, কিছুক্ষণের ভেতরই বিড়ির উৎকট গন্ধে ম ম করতে থাকে মোল্লা বাড়ির আমবাগান। আরেকটা ছেলে তাকে কাজে সাহায্য করছে।
—ও বাজান, খারাও। জিরায়া লই। বিড়ি খাও?
—না মিয়াসাব, বিড়ি খাই না।
বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছেলেটিকে ভালো করে লক্ষ করেন নিবাস মাঝি। এ বাড়িতেই তাকে আরও কয়েকবার দেখেছেন তিনি। কিন্তু এ মোল্লাবাড়ির কামলাশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত অবশ্যই। মোল্লাবাড়ির কারও কোনো আত্মীয় নয়। ভুরু কুঁচকে ওঠে নিবাস মাঝির।
—কানতাছিলা ক্যান মিয়া?
—কখন?
—খানিক আগে। আমি দেখলাম।
মুখ ঘুরিয়ে নেয় নিখিল। হাসুর লাশটা সেই আমগাছ থেকে নামিয়েছে। কী শক্ত সেই ফাঁসের গেড়ো! অনেক চেষ্টা করেও কাটতে পারছিলো না সে। নিচে থেকে চিৎকার করছিলেন কানু মোল্লার ছোট ভাই নিজামউদ্দীন মোল্লা৷
—ওই হারামি, সাবধান ছুবি না।
নিখিলের খুব ইচ্ছা করছিল হাসুর নরম কাধটা একটু ছুঁয়ে দিতে। কী সুন্দর ফর্সা সেই কাঁধ! নীলচে রক্ত জমে উঠতে শুরু করেছে সেখানে। ঘন কালো চুল আমবাগানের বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে দুলতে থাকে। প্রেয়সীর নিথর দেহের চঞ্চল কেশের ঝাপটায় শিহরিত হতে থাকে নিখিল। মৃত হাসুর শরীর থেকেও সেই একইরকম চেনা মিষ্টি গন্ধ আসছে। আমের অপরিণত বোলের গন্ধের সঙ্গে মিশে সে গন্ধটা যেন একটা মায়ার জন্ম দিয়েছে। কোনোমতে গেরোটা কেটে লাশটা নামিয়ে আনে নিখিল। তাল সামলাতে পারে না। মুখ থুবড়ে পড়ে যায় হাসুকে নিয়ে। আহা, তার হাসু। বুকের মাঝখানে এভাবে চেপে ধরে একটা জীবন খুব সহজে কাটিয়ে দিতে পারতো সে। নিজামউদ্দীন মোল্লা খেকিয়ে উঠলে তাল সামলিয়ে উঠে দাঁড়ায় নিখিল।
—ও মিয়া, আবার কান্দো ক্যান? সে কি তোমার সখী?
এবার আর সহ্য করতে পারে না। উঠে এসে অজানা বিকারে নিবাসের মুখ চেপে ধরে নিখিল। বিড়ির ধোঁয়ায় প্যাঁচ লেগে যায় নিবাসের বুকে, খুকখুক করে কাশতে থাকে। চোখ লাল হয়ে আসে। হাতের খুন্তিটা ফেলে লাফিয়ে কাশতে থাকে৷ ওদিকে খুন্তিটা তুলে নিয়েছে নিখিল। তার চোখ আরও লাল। চোখ দিয়ে আগুন ঝরে পড়ে। এই চোখ দিয়ে যেন আরও সহস্র ঝলসে যাওয়া হিজলের প্রাণ নিয়েছে সে। হঠাৎ চিৎকার শুরু করে পৃথিবীকে জানান দিতে থাকে নিখিল, হোক সে মালোয়ান; হাসুর শেষবিদায় জানাজায় আজ সেও থাকবে, কবরে মুঠোভর্তি মাটি সেও দেবে। আর কেউ তাকে আজ আটকাতে পারবে না। হোক সে মালোয়ান। মানুষ তো! মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে খাবারের জন্য ছাড়াও নিজের স্বজাতিকে হত্যা করতে পারে। সুতরাং আরেকটা মানুষের লাশ সে ফেলতে পারবে।
পাড়ার মসজিদে আজান শেষ করে মুয়াজ্জিন বাদ নামাজ হাসুর জানাজায় এলাকাবাসীকে শামিল হতে অনুরোধ করছিলেন। হাত থেকে খুন্তি ফেলে দেয় নিখিল। উবু হয়ে পায়জামায় গোছ দেয়। ওজু করতে হবে। কানু মোল্লার হাত থেকে বদনা ছোঁ মেরে কেড়ে নেয় নিখিল। বদনাভর্তি পানি নিয়ে বসে যায় জলচৌকির ওপর। মানবসন্তান আনাড়ি অমুসলমান নিখিলের ওজু খোদাতায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা নিয়ে চিন্তা করে না সে। কুলকুল করে কুলি করে পিক করে পানি ফেলে কানু মোল্লার পায়ের কাছে।