রেণুগুলো, ঋতুর ভেতর
বয়স্ক মানুষেরা লাইন ধরে দাঁড়িয়েছে ভাষাশিক্ষার স্কুলে।
জীবনের জন্য ভাষা চাই। অথবা পথ্যের জন্যেও।
সবজি-তরকারি’র বাজারে গিয়ে কেনা-কাটা; কিংবা
তাজা শাকের রঙ যাচাইয়ের জন্যেও দরকার ইশারার
দক্ষতা-কথার পর কথা।
কথা বলতে বলতেই আমি শিখে যাই ‘শরণার্থী’ ও ‘অভিবাসী’
শব্দ দু’টির পার্থক্য। আইফেল টাওয়ারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে
যারা প্লাস্টিকের টাওয়ারমূর্তি বিক্রি করছে, তাদের একজন
আমাকে ‘কেমন আছেন’ বলার পর সম্বিৎ ফিরে পাই।
প্যারিসের সিন নদীর তীর ঘেঁষে যে পুষ্পগুলো রেণু ছড়াচ্ছে;
তারাও পালন করে গ্রীষ্মকাল। ঋতুর ভেতর প্রেমের উষ্ণতাই
অন্যরকম। ভাবতে ভাবতে আমি নদীটির ঢেউয়ের দিকে তাকাই।
একটি কাগজের নৌকোয় ভেসে যাচ্ছে এক জুটি তালা-চাবি।
প্যারিসের পাখি
কড়া রোদের ডানায় উড়ছে আকাশ। কিছু মেঘ
মনযোগ দিয়ে পড়ছে, শেক্সপিয়ারের রেখে যাওয়া স্মৃতি।
বই কেনার জন্য যে জিপসি যুবক দাঁড়িয়েছে লাইনে,
তার চোখের সামনেই খুলছে ক্যাশবাক্সের তালা।
নাহিয়ান, আমার মেয়ে-দেয়ালে পড়ছে এল্যান গিনসবার্গের
হাতের দাগ।
আমি নতুন করে ডেটিং করছি, তুলি’র সাথে। রঙধনু রঙের
কফিকাপের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একজোড়া প্যারিসের পাখি।
আমার ছোট্ট মেয়েটি নাশরাত, রুমি’র লেখা পুরনো বইটির
নতুন সংস্করণের মূল্য পরিশোধ করে দৌড়ুচ্ছে পার্কে।
ফুলের শহর প্যারিস। কবির শহর প্যারিস।শিল্পের শহর
প্যারিস। প্রেমে প্রেমে ভরে যাচ্ছে পাতা। প্রশাখাগুলোর
সতেজ বাহু, মানুষের জন্য ছড়াতে চাইছে সাম্যের সুন্দর।
নেশাপ্রস্ত, নিশি’র শ্মশান
‘সবগুলো নিশিকে এই খোলামাঠে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।
অথবা বলতে পারেন, যারা নেশা করে এই রাতগুলোকে
করতে চেয়েছিল আপন-তারা আত্মাহুতি দিয়েছিল
এই মাঠে।’
‘কিন্তু এখন তো মাঠ দেখছি না’-আমি বলি।
গাইড আমাকে আকাশের দিকে তাকাতে বলেন।আমি
নির্মেদ আনন্দ নিয়ে অকাশ দেখতে অভ্যস্ত বিধায়-
তার আঙুল অনুসরণ করি।
অনেকগুলো হলুদ ফ্ল্যাট গড়ে উঠেছে এখানে।মেঘের
কার্ণিশ ছুঁয়ে কেউ শুকাতে দিয়েছে ভেজা কাপড়।
না-নেশার কোনো গন্ধ নেই এখন। সদ্য লাগানো
ফুলগাছগুলো জড়িয়ে রেখেছে সবুজ ঘাস-লতা-গুল্ম।
শিশুরা বিকেল ডিঙিয়ে হাঁটছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে গোল
বল হাতে নিয়ে খেলার। বদলে গিয়েছে প্যারিস!
‘আরও বদলে যাবে। একদিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত
মানুষদের অচিহ্নিত সমাধিগুলোও চাপা পড়ে যাবে
ফ্ল্যাটের নিচে।’-গাইড একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমাদের
অন্যপথে নিয়ে যান।
প্যারিস: ১৩ নভেম্বর ২০১৫
২০১৭-এর আগস্টের একটি বিকেলে আমি সেন্ট ডেনিসের
‘স্টাডে ডি ফ্রান্সে’র পাশে দিয়ে হেঁটে যাই। রক্তের দাগ
মুছে গেলেও এখনো বেঁচে আছে বৃক্ষের বাকল। পুরু
স্তর সাজিয়ে পাথর সন্তানেরা-
দেখাচ্ছে তাদের চোখ। সাক্ষী থেকে সমকালের,
১৩০ জন মানুষের ছবি তাকিয়ে দেখছে আমাকে।
শোক এখন আর আমাদের সড়কগুলো ঢেকে দিতে পারে না।
বরং রক্তাক্ত হাত উঁচিয়ে আমরা বলতে থাকি-‘দাঁড়াও মানুষ!’
দাঁড়িয়ে থাকো এই আইফেল টাওয়ারের মতো শির উঁচু করে।
আমরা এখন আর কোনো উৎসবের দর্শক হবো না। আমাদের
রোজমানচায় আর লিখিত হবে না কোনো ছন্দের স্বরঝংকার।
যারা আমাদের প্রতিবেশে সেরে নিচ্ছে তাদের সংহারপর্ব—
আমরা এখন শুধু নীল কালিতে আঁকবো সেইসব শকুনের প্রতিচ্ছবি
রেখে যাবো আগামী প্রজন্মের জন্য—
যাতে তারা জানতে পারে, ঘোষিত কোনো বিশ্বযুদ্ধের দামামা
না থাকলেও, কেউ কেউ এই পৃথিবীর মাটিতে বসাতে চেয়েছিল
তাদের নখের দাগ। ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল আমাদের সবটুকু মায়া।
পল এলুয়ার কিংবা আর্তুর র্যাঁবো’র জন্যে যতি
জীবনের কোনো হিসাব-নিকাশ আমি পল এলুয়ার কিংবা
আর্তুর র্যাঁবো’র জন্য লিখে যাচ্ছি না। সে কথা জানাতেই
সগর্বে পা রেখেছিলাম প্যারিসের মাটিতে।ইংল্যান্ডের, লুটন
বিমানবন্দর থেকে প্যারিসের চার্লস ডি’গাল বিমানবন্দরে
নামার আগেই একপশলা বৃষ্টি ধুয়ে নিয়েছিল আমার সকল
দুঃখ। ছাতার নিচে লুকিয়ে থাকা দু’চোখের জ্যোতি-
কেবল আমাকেই দেখেছিল, অথচ আমি কিছুই দেখিনি।
খড়কুটো দিয়ে যে প্রেমিকার মুখ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন
পল এলুয়ার, আমি তার সাকিন খুঁজিনি।বরং ভাস্কর্য দেখেই
ছবি তুলতে চেয়েছি বৃষ্টিবিম্বের। শাসিত সৈকতগুলোর মতো-
ছুঁতে চেয়েছি অনেকগুলো নাতিদীর্ঘ কবিতার পরাজগৎ।
বলতে পারি, যে ইচ্ছেজন্মকে পুনঃনির্ধারণ করে ৩৭ বছর
জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন আর্তুর র্যাঁবো-
খুঁজতে গিয়েছিলাম তার পদরেখা। কিছু অনিশ্চিত বিদ্যুৎ;
চমকেছিল আমার মাথার ওপর, রাগে ও পরাগে।
কয়েকটি লালপর্দার ভেতরেই মোড়া থাকে একটি কবিজীবন।
কয়েকটুকরো মেঘ সরে গেলেই, আবার মুখ দেখায়
কবি’র প্রেমিকা। সে কথা বলতেই,
এলুয়ার কিংবা র্যাঁবোকে শোনাতে চেয়েছি
ভিক্টর হুগো’ লিখিত সমুদ্রজোয়ারের বিশদ প্রশংসা।