আমার আক্রোশ ঠিক কার প্রতি? অন্ধকারে যে পাথরটায় উষ্ঠা খেয়েছি, তার প্রতি? না কি অন্ধকার, অথবা নিজের প্রতি? পাথরের চোখা প্রান্তে লেগে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা কেটে গেছে। হাড়ও ভেঙে গেছে বোধ হয়। সেখান থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। যদিও গাঢ় অন্ধকারে তা দেখতে পাচ্ছি না। সেই দেখতে না পাওয়ার প্রতি আক্রোশ নয় তো?
এ রকম ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়াচ্ছি। অদ্ভুত, দাঁড়াতে পারছি না। কে যেন টেনে ধরছে। অথবা উঠে দাঁড়ানোর পদ্ধতি ভুলে গেছি। কিভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়—গত ত্রিশ বছরেও এটা শিখতে পারিনি; এর আগে কখনো উঠে দাঁড়াইনি? অথবা কখনো কি পড়ে যাইনি?
অদ্ভুত, অদ্ভুত। কেউ কি আমাকে উঠে দাঁড়াতে শেখায়নি। নাকি কেউ কখনো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি। এতকাল, ত্রিশটি বছরে একবারও কি ভূপাতিত হয়নি!
এসব ভাবতে ভাবতে আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। একই ফল—পারছি না। তারচেয়ে বরং রক্ত বন্ধের চেষ্টা করা যেতে পারে। এবার স্মৃতি সক্রিয় হয়ে উঠলো। রক্তের ডাক বলে কথা! ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে কোথাও কাটা গেলে একধরনের লতা থেঁতলে তার রস ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেই বন্ধ হয়ে যেতো রক্তপাত। এরকম আরও অনেক টোটকা ছিল।
এই অন্ধকারে সেই লতা খুঁজবো কী করে? খুঁজতে হলে সেই তো উঠে দাঁড়াতে হবে। রক্ত বের হতে থাক। আঙুলটা টনটন করছে। সেটাই বরং এই মুহূর্তের সমস্যা। ব্যথা কমার ওষুধ খেয়ে খেয়ে ফেলা যায়। অথবা আক্রোশ নিয়ে ভাবা যায়।
ধরাশায়ী হওয়ার আগে কী করছিলাম? কোনো প্রেমিকার সঙ্গে অভিসারে ছিলাম। গোপন কক্ষ থেকে তাড়াহুড়া করে বের হতে গিয়ে এই পতন! হয়তো, হয়তো নয়। এমনও হতে পারে, রোগী দেখে বাড়ি ফিরছিলাম, সেই রোগীর কষ্টের কথা ভাবতে ভাবতে আনমনে হাঁটছিলাম। অথবা, বন্ধুদের সঙ্গে মহুয়ার বন উজাড় করে উড়ছিলাম, আর উড়ছিলাম—যা আসলে গড়াগড়ি। হয় তো কোনো সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহিলাকে শিষ দিয়েছিলাম! তার অগ্নিচক্ষুতে ভস্ম হয়ে খসে পড়লাম ভূমিতে।
কোনো সুঠাম পুরুষ বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে উল্টা দিক থেকে আসছিল। তার বিড়ির আগুনকে মনে হচ্ছিল নিঃসঙ্গ জোনাক পোকা। লাল জোনাক! গভীর অন্ধকারের সেই আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে দেখতে পাথরটায় টক্কর খেয়েছিলাম না তো!
এক বন্ধু বলেছিল, ‘পথে সাবধান, একটা গরু বাঁধা থাকে রাস্তায়। ওটাকে দূর থেকে অতিক্রম করবি।’ তাহলে কি সেই গরুই আমার …। না, আমার তো কোনো বন্ধুই নেই। সাবধান বাণী, গরুটরু এইসব অলীক। চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, স্ত্রীর সঙ্গে তুলকালাম ঝগড়ার মাঝপথে ঝড়ের বেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। আর প্রেয়সী সেই অসম্পূর্ণ ঝগড়ার অতৃপ্তি নিয়ে প্রবল অভিশাপ ছুড়ে দিয়েছিল। তার ফল এই রক্তপাত ও পতন!