‘শোকে ভাসা মানুষের মতো
একদল কাক
বিলাপ করছে একটি
মৃত কাক ঘিরে।
একসঙ্গে
এতো কাক জড়ো হল
দেখে কার না মায়া হয় আহা!যেন চিঠি দিয়ে নিয়ে
আসছে
দূর সমুদ্দুর থেকে।
কী সাংঘাতিক ঘটনাটি ঘটে গেল
আত্মীয় বলয়ে!
হায়! শোকার্ত পরিজন এরা
ধৈর্যহীন কাঁদে!’
কবিতার নাম ‘মৃতের পাশে আত্মীয়দের বিলাপ’। কবি নূরুল হক। জন্মেছিলেন নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার বালালী গ্রামে। সময় ১৯৪৪ সালের ২৫ নভেম্বর।
২০১০ সালে অমর একুশে বইমেলায় ১১ ফেব্রুয়ারি লিটল ম্যাগ চত্বরে কবি সরোজ মোস্তফা এই কবির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। এর আগে আমি তার নাম পর্যন্ত জানতাম না। কবি আমাকে ‘একটি গাছের পদপ্রান্তে’ বইটি উপহার দিলেন। ওই সময় পর্যন্ত আমি বিভিন্ন ছোট কাগজে মাবুদ এনাম নামে কবিতা লিখতাম। নূরুল হক আমাকে মাবুদ এনাম সম্বোধন করে অটোগ্রাফ দিলেন। বইমেলা থেকে ফিরে বইটি পড়ে শেষ করার পর মনে হলো এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন? আগে কেন তার কবিতার সঙ্গে পরিচিত হলাম না?
বাংলা কবি ও কবিতার দুঃসময়ে নূরুল হকের মতো কবিরা আড়ালে থেকে যাওয়ায় এইসব কবির কবিতার সুবাস থেকে আমরা বঞ্চিত হই। ‘পাদটীকা’ নামের একটি কবিতায় কবি নূরুল হক ঘোষণা দেন:
‘জীবন এক অপূর্ব দৃশ্য,
যা দেখে মানুষ
বাড়ি ফেরার কথা
ভুলে যায়।’
কী অদ্ভুত শিহরণ হয় এই বাক্য পাঠ করলে! জীবনকে তিনি কবিতায় ধরতে পেরেছিলেন। তার কবিতার পরতে পরতে জীবন।
এই শতকের ভয়াবহ মহামারী করোনাকালে বেশ কয়েকদিন আইসিইউতে থেকে যুদ্ধ করেছেন তিনি। জীবনের অপূর্ব দৃশ্য আরেকটি বার তিনি দেখতে পাবেন বলে আমরা আশা করেছিলাম
নূরুল হক জীবনবাক্যের কবি। তার জীবনবাক্য আমাদের চিন্তায় বিদ্যুৎ-চমক জাগায়, আলোড়িত করে বোধ।
‘দেখি,
হাওয়ার ওপর ভাসছে
একটি লতা।
সেই লতাই কি আমি?’
জীবদ্দশায় কবি নূরুল হকের নাম অনেকেই উচ্চারণ করেননি। কবি নিজেও ছিলেন নিভৃতচারী। নীরবেই তিনি লিখেছেন:
‘এক নিমকহারাম
পৃথিবীতে
আমাদের দিন ফুরিয়ে যায়।’
মাটি আর ভাটির সন্তান কবি নূরুল হক ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাস করেন। একাত্তরে হাতে নিয়েছিলেন দেশের জন্য অস্ত্র। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে জীবন বাজি রেখেছিলেন। কলেজে শিক্ষকতা করে কাটিয়েছেন জীবন। নিজের মতো করে কবিতা লিখেছেন। তার কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে– ‘শাহবাগ থেকে মালোপাড়া’, ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’, ‘একটি গাছের পদপ্রান্তে’, ‘মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প ও অন্যান্য কবিতা’ ও ‘এ জীবন খসড়া জীবন’।
এই শতকের ভয়াবহ মহামারী করোনাকালে বেশ কয়েকদিন আইসিইউতে থেকে যুদ্ধ করেছেন তিনি। জীবনের অপূর্ব দৃশ্য আরেকটি বার তিনি দেখতে পাবেন বলে আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু সবাইকে আশাহত করে এই মহান কবি ২২ জুলাই ২০২১ তারিখে জীবনের মায়াবী ভ্রমণ সমাপ্ত করে চলে গেছেন নতুন জীবনের সন্ধানে। কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
আরও পড়ুন: অভাজনের এপিটাফ ॥ নূরুল হক