মাতাল হারান পাল। সারাদিন উদম গায়ে চটের কারখানায় গতর খাটায়। সন্ধে হলেই বিনোদিনীর চাঁচের সরাইখানায় বসে গ্লাস গ্লাস সস্তা মদ গেলে। তার কাছে এটা দুনিয়ার স্বর্গ, বিনোদিনী সুন্দরের দেবী। এরপর রাত বাড়লে নেড়ি কুকুরের মতো উবুড় হয়ে শুয়ে থাকে বড় রাস্তার তিন নম্বর ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয়।
আহারে হারান পাল। এমন দুর্দশা কি তার ছিল! সোনার লাহান সংসার ছিল, চান্দের লাহান বউ, একটা পোলা ছিল চার বছরের। সারাদিন রিকশা চালিয়ে সন্ধ্যায় বউয়ের জন্য আলতা সিঁদুর পোলার জন্য নিয়ে আসতো লাল লাল মিঠাই। ঘাম মাখা গতরে পোলাডারে জড়িয়ে ধরে বলতো ‘আহারে ছাবাল আমার, সাত রাজার ধন, বুকের মানিক আমার।’ বউ গাঢ় করে সিঁদূর দিতো মাথায়। মাটির বিছানায় ভাত খুলে বাতাস দিতো। আহারে জোয়ান ভাতার, সারাডা দিন কি খাটুনিটাই না খাটে। হারান পাল মুখে হাসি নিয়ে ভাত খায়, বউ বাতাস দেয় আর মনেমনে বলে ‘আমার মিনশে কি সুন্দর করেই না হাসে। মানুষটা বড় ভালা’। বউয়ের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।
কি সুখটাই না ছিল আহা। অত সুখ কি গরিব মাইনষের কপালে সয়! পোড়ামুখী দুঃসময় এসে কেড়ে নিয়ে গেল সব। সর্বনাশী আগুন বস্তির সঙ্গে পুড়িয়ে দিল পিরিতে বাঁধা ঘর, বুকের হাড়, পুড়িয়ে দিল সুখ। সোনার সংসার, বউ, ছেলে সব চিতায় জ্বললো দাউদাউ করে।
হারান পাল রোজ রাতে মদ খেয়ে শুয়ে থাকে রাস্তায়। তার কলিজায় জ্বলা চিতা, মদের স্পর্শ ছাড়া নেভে না। মদের ঘোরে সে তার বউডারে দেখতে পায়, পোলাডারে দেখতে পায়। মাঝরাতে পুলিশের জিপ এসে থামে বড় রাস্তার তিন নম্বর ল্যাম্পপোস্টের নিচে। একটা ভারী লাত্থিতে জেগে ওঠে মাতাল হারান। দারোগার কর্কশ কণ্ঠে ঝরে পড়ে আগুন ‘ওঠ শালা, নিমাই মাস্টারের মেয়েকে ধর্ষণ করে এখানে চিৎ হয়ে ঘুম মারানো হচ্ছে! মালাউনের বাচ্চা। ওঠ গাড়িতে ওঠ…
গাড়িতে বসে ঠা ঠা অন্ধকারে হেসে ওঠে দারগার মুখ। এমপি দশ লাখ টাকা নিয়ে বসে আছে থানার বারান্দায়। তার ছেলের বদলে কাল কোর্টে চালান হবে হারান পাল। আহারে হারান! মাতাল হারান! গাঢ় অন্ধকারে গুমরে কাঁদে সমস্ত আকাশ!