জলদস্যুদের নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। রোমহর্ষক নানা কাহিনি প্রচলিত আছে জলদস্যুদের নিয়ে। পুর্তগিজরা বাংলায় আসার পর তাদের একটা অংশ বাংলার বিভিন্ন নদ-নদী ও বঙ্গোপসাগরে নৌকাবহর নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করত। এই পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারে বাংলার নৌপথে বাণিজ্য করাটা ওই সময় কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাদের বলা হত আর্মাডা, বাঙালিরা বলত হার্মাদ, যাদের ‘পাইরেটস অব দ্য বেঙ্গল’ বললেও ভুল হবে না।
পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান মুভি সিরিজ আমাদের জলদস্যুদের কাল্পনিক সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়। এই মুভি সিরিজের সাফল্য কম নয়। সর্বকালের সেরা দশ ব্যবসা সফল মুভি সিরিজের ভেতর ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান’ একটি। ২০০৩ সালে ‘দ্য কার্স অব দ্য ব্লাক পার্ল’ দিয়ে এর যাত্রা শুরু, তবে এটি এতটা জনপ্রিয় যে, এর শেষ কবে তা এখন কেউ বলতে বলতে পারবে না।
এই কাল্পনিক মুভি সিরিজের কাহিনি আঠারো শতকের প্রথম দিকের, যখন ব্রিটিশ সম্রাজ্যের আধিপত্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমুদ্রেও তাদের রাজ প্রতিষ্টা করতে চাই, এছাড়া সমুদ্রে আছে স্প্যানিশ ও জলদস্যুরা। ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ানে’ জলদস্যুদের স্বাধীনচেতা হিসেবে দেখানো হয়েছে ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে তাদের স্পষ্ট অবস্থান।
২০১১ সালে ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ানে’র ৪র্থ সিনেমা অন স্ট্রেঞ্জার্স টাইডের পর দীর্ঘ ৬ বছরের অপেক্ষা। অবশেষে ২৬ মে ২০১৭ বিশ্বব্যাপী মুক্তি পেল পাইরেটস পব দ্য ক্যারাবিয়ানের ৫ম সিনেমা ‘ডেড ম্যান টেল নো টেলস’। এই প্রথমবারের মত হলিউডের অধিক আলোচিত এই সিরিজের সিনেমা পরিচালনা করেছেন আমেরিকার বাইরের দুজন পরিচালক।
নরওয়ের দুজন উঠতি পরিচালক জোয়াকিম রোনিং এবং এসপেন স্যান্ডবার্গ পরিচালনা করেছেন ‘ডেড ম্যান টেল নো টেলস’। জেফ নাথানসনের স্ক্রিপ্টে ডিজনির এই সিনেমাটি নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ ছিল না। তবে ডেড ম্যান টেল নো টেলসকে বলা যেতে পারে, ঘষা মাজা করা পুরোনো জিনিস। কিংবা বলা যেতে পারে, সিনেমাটির মাধ্যমে নতুন বোতলে পুরনো মদ খাওয়ানো হয়েছে। খুব বেশি অবাক করার মত বিষয়াদি সিনেমাটিতে নেই। আপনি যদি পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ানের তুখোড় ভক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে সিনেমাটি দেখলে আপনার এটাও মনে হতে পারে এগুলো আপনি আগেও দেখেছেন। নতুনত্বের চমক এখানে নেই, সেই পুরনো ঢঙে একটি নতুন গল্পের উপস্থাপনা হয়েছে মাত্র।
ক্যাপ্টেন আর্মান্ডো সালাজার ফিরে এসেছে প্রতিশোধের জন্য। মানুষ হিসেবে নয়, এক আজব ভৌতিক রূপ নিয়ে ভৌতিক এক জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে তার প্রত্যাবর্তন। তার নাবিকেরাও সবাই কিম্ভূতকিমাকার ভূত। ক্যাপ্টেন সালাজারের একমাত্র উদ্দেশ্য সমুদ্রের সবচেয়ে দক্ষ জলদস্যু ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোকে হত্যা করা, কেননা জ্যাক স্প্যারোই তাকে হত্যা করেছিল। এজন্য সমুদ্রের সব জাহাজকে ধ্বংস করতে থাকে ক্যাপ্টেন সালাজারের ভূতবাহিনী। মৃত মানুষেরা অযথা খোশ গল্প করতে পৃথিবীতে ফিরে আসে না, তারা আসে ধ্বংস করতে, এ জন্যই হয়তো সিনেমাটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডেড ম্যান টেল নো টেলস’।
ক্যাপ্টেন সালাজারের রোশ থেকে মুক্তি পেতে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্পারোর হাতে একটিই পথ। তা হলো সমুদ্রের গভীরে লুকায়িত ‘ট্রাইডেন্ট অব পোসাইডন’ খুঁজে বের করা। এটি দিয়ে সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এমনকি সমুদ্রের যাবতীয় অভিশাপ মোচনও সম্ভব।
সকলের প্রিয় চরিত্র মাতাল ক্যাপ্টেন জ্যাক স্পারোর মাধ্যমে আবার ফিরে এসেছে জনি ডেপ। তবে পুরো সিনেমাজুড়ে জনি ডেপকে দেখা গেছে হাস্যরসাত্মক একটি চরিত্র হিসেবে। কিছু বাজে এবং অপ্রাসঙ্গিক কৌতুক তো আছেই। জনি ডেপকে আগের পর্বগুলোর মত সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে পরিচালক মহোদয়েরা। তাই পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ানের পরবর্তী সিনেমায় জনি ডেপকে নেওয়া উচিত কি না, এটাও ভাবার বিষয়।
স্প্যানিশ অভিনেতা জাভিয়ার বার্ডেম ক্যাপ্টেন সালাজারের চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছে। অনেকে সালাজারের এনিমেটেড চুল নিয়েও কৌতূহলী ছিল। জিওফ্রে রাশ ক্যাপ্টেন বারবোসা হিসেবে আগের মতোই অসাধারণ। শেষের দিকে ক্যাপ্টেন বারবোসার আত্মবিসর্জন পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান ভক্তদের এক আবেগী মুহূর্তের ভেতরেই ফেলে দেবে।
সিরিজে নতুন দুই চরিত্রের সংযোজন কারিনা ও হেনরির রসায়ন বেশ ভালোই জমজমাট। কারিনা চরিত্রে কায়া স্কোডেলরিও বেশ দারুণ অভিনয় করেছে। কারিনা সে সময়ের একজন উন্নত মস্তিষ্কের স্বাধীনচেতা নারী জ্যোতির্বিদ, জ্ঞানচর্চায় আগ্রহের জন্য যাকে ডাইনি উপাধি দিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। সে জানত ট্রাইডেন্ট অব পোসাইডনের অবস্থান। অন্যদিকে ব্রেনটন থোয়েটস হেনরি চরিত্রে এক টগবগে যুবক, যে সমুদ্রকে ভালোবাসে এবং ক্যাপ্টেন জ্যাক স্পারোকে তার বড্ড প্রয়োজন। কেননা, তার ধারণা, শুধু ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোই তাকে নিয়ে যেতে পারবে ট্রাইডেন্ট অব পোসাইডনের কাছে। শুধু ট্রাইডেন্ট অব পোসাইডনই পারে তার বাবাকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে।
‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ানে’র অন্য সিনেমাগুলোর তুলনায় এই সিনেমাটির একশন দৃশ্যগুলো খুব একটা যুৎসই হয়নি। সিরিজের ১ম ও ২য় সিনেমা যে তুমুল আন্দোলন দর্শকদের মনে তুলেছিল তা খানিকটা হলেও ৪র্থ এবং ৫ম সিনেমা স্তিমিত করে দিয়েছে। তাই বলে, পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ানের ভক্ত সংখ্যা কমে যাবে এটা ভাবার ফুসরত নেই। কেননা, জলদস্যু নির্ভর সিনেমার ভিতর পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
ডেড ম্যান টেল নো টেলসের সবচেয়ে ভালো দিক শেষ দৃশ্যগুলোর নাটকীয়তা। এই নাটকীয়তার জন্যই সিনেমাটি হালে পানি পাচ্ছে। শেষের দিকে একেক পর এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটতে থাকে, একারণে এটাকে পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ানের তৃতীয় সেরা সিনেমা বললেও ভুল হবে না।
আপনি ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান: ডেড ম্যান টেল নো টেলস’ দেখতে গিয়ে হতাশ হবেন না। হয়তো প্রতিটি দৃশ্য তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করবেন। সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াই যেন শেষ হওয়ার নয়, ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর রহস্য উদঘাটন করাও দুঃসাধ্য। বোতলে ভর্তি করে জাহাজ পকেটে পুরে নিয়ে বেড়ানো মাতাল, কৌতুকী ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো সমুদ্রে আরেকটা অভিযানে আবার ফিরে আসবে এটাই সবার আশা। সেই জ্যাক স্প্যারো জনি ডেপ হোক কিংবা অন্য কেউ হোক এতে হয়তো কারও তেমন সমস্যা নেই।