এক.
এক টুকরো ফাঁকা জায়গায় শুকনো কাঠকুটো জড়ো করছে ক’জন তরুণ। উদ্যানে তখন সন্ধ্যা নেমেছে—চারদিকে অন্ধকার ক্রমশ জমাট হয়ে উঠছে। শুকনো ডালপালা পর্যাপ্ত জমে উঠলে স্বচ্ছ কাচের বোতল হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো একজন। আলো যদিও অল্প, তবু দিব্যি বুঝতে পারা গেল বোতলের ভেতর দাহ্য যে তরল অপেক্ষায়, তার রং নীল। কেউ একজন অন্য কারও কথায় সায় জানিয়ে বললো, ‘হুম হুম, কেরোসিনই। দাহ্য কেরোসিন তুমি কবিতার মতোই রঙিন বহুরঙে।’ বোতলটা যার হাতে ছিল নাটুকে কণ্ঠে সে বলে উঠলো, ‘তা তো বটেই। তবে আমার কী মনে হচ্ছে তাও শোনো, শুনে মিলিয়ে দেখো। আমি বলি কাচের বোতলে আটকা পড়েছে আকাশবিম্ব সমুদ্রজল। ঠিক কি না!’
রূপালি ঢাকনা মুচড়ে খুলে নিয়ে বোতল উপুড় করা হলো। ডবডব শব্দে স্বচ্ছ নীল তরল ধারায় পড়তে শুরু করল কাঠকুটোর ওপর। অন্য এক তরুণ এগিয়ে এসে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করলো দিয়াশলাইয়ের বাকশো। একটা বারুদকাঠি বের করে ঘষে আগুন ধরিয়ে আঙুলের চিমট থেকে পড়ে যেতে দিল ওই ভেজা কাঠকুটোর স্তূপটার ওপর।
কট কট শব্দে আগুনে-শিখা কাঠ পোড়াতে পোড়াতে ক্রমে বড় হয়ে উঠল। রাতের বাকি কালোটুকুও দ্রুত নেমে এলো।
আগুনের শিখা তার মাহাত্ম্য দেখাতে শুরু করলে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ইজেলের ওপর দাঁড় করানো একটি ব্যানার। তাতে লেখা—কবিতা পোড়ানো উৎসব ২০১৪।
লাকড়ি পোড়া মিষ্টি-কটূ গন্ধে ভরে উঠলো চারপাশ। আগুনের আলোয় সোনারঙ হয়ে উঠলো তরুণ মুখগুলো। একজন এগিয়ে এসে একটা ঘোষণাপত্র পড়তে শুরু করল গম্ভীর কণ্ঠে। বলে গেল কবিতা পোড়ানো উৎসব কী ও কেন এবং কারা এতে অংশ নিতে এসেছে। একটানা পড়ে চললো বক্তা তরুণ, তবে তাড়াগুড়োয় নয়। বরং চাইলে কেউ তার উচ্চারিত শব্দসংখ্যা গুনতে পারে এমন গতিতে। অবশেষে এই বলে তার ভাষণ শেষ হলো, ‘সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে আমি সিপাহী রেজা কবিতা পোড়ানো উৎসব ২০১৪-এর উদ্বোধন ঘোষণা করছি।’
সিপাহী রেজার পড়া শেষ হলে প্রথম যে তরুণ কেরোসিন হাতে এসেছিল, এবার এগিয়ে এলো সে-ও। তার হাতে ধরা একটা ভাঁজ করা কাগজ। ভাঁজ খুলে তাতে লেখা কবিতা পড়ে শোনালো সবাইকে। পাঠ শেষ হলে সবার উদ্দেশে সে বললো, ‘নিজের লক্ষ্যকে যতটা জানি, তার বিচারে এ কবিতা আমার প্রতিনিধিত্ব করে না বলে আমি অরবিন্দ চক্রবর্তী স্বেচ্ছায় কবিতাটিকে আগুনে পুড়িয়ে দিলাম।’ কবিতা লেখা কাগজটা এবার ধীরে-ধীরে আগুনের কাছে নামিয়ে এনে ছেড়ে দিল ওই তরুণ। যখন উঠে দাঁড়াল তার চোখজোড়ায় জল ঝিকমিক করছে।
কাগজে ক্রমশ উঠে এলো আগুন যেন পাহাড়ের কিনার ধরে চড়াইয়ে উঠে আসছে কোনও নির্লিপ্ত সরীসৃপ। পুড়ে কুঁচকে যেতে শুরু করলো সাদা সেলুলোজ, বাতাসে কাঠ পোড়া গন্ধের সঙ্গে কাগজপোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। জড়ো হওয়া তরুণদের একজন কবিতা পোড়ানো উৎসবের জটলা ছাড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকলো ঘন-ঘন যেন একটা কিছু খুঁজছে। এমন সময় সঞ্চালক তরুণ কাঁধে হাত রেখে জানালো এবার তার কথা বলার পালা। পাঞ্জাবির পকেটে হাত রেখে আগুনের সামনে যাওয়ার আগে পাশের জনকে অনুরোধ করে গেল কবি, কোনও কিশোরকে ঘিরে জটলা তৈরি হতে দেখামাত্র যেন তার পাঞ্জাবিতে টান পড়ে।
দুই.
বহ্নিউৎসব থেকে কিছু দূরে একটা গোলচত্বরের সীমানা দেয়ালে সার বেঁধে বসে আছে প্রৌঢ়দের একটা দল। কবিতা পোড়ানো উৎসব বিষয়ে আলাপ চলছে তাতে পক্ষ-বিপক্ষও দাঁড়িয়ে গেছে। একজন কণ্ঠে শ্লেষের গরল নিয়ে বললো, ‘ধুর! যত আদেখলেপানা আর ভাঁড়ামি। কবিতা পোড়াচ্ছেন তেনারা হ্যাহ! আর কাজ নেই।’ পাশের জন মাথা ঝাঁকিয়ে সমর্থন জানিয়ে বললো, ‘সেটাই, যেন কত বড় বিপ্লব হয়ে যাচ্ছে আহা!’
দু’জনের কথার প্রতিবাদ করে উঠে একজন বললো, ‘হুম, আসলে যা বুঝলাম তা হলো, এই তরুণরা যাই করে তাতেই তোমাদের নাক সিঁটকাতে হয়, নয়তো জাত থাকে না। আমি ঘোষণা করছি, আমার শতভাগ আস্থা ওদের ওপর আছে, হ্যাঁ। ওদের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখি আমি, কেন রাখব না? ওই তাকিয়ে দেখো। কবিতা ওরা পোড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আগুনে ফেলার পর চোখও না মুছেও থাকতে পারছে না। ত্যাগের এমন মন যদি না জন্মে কবি হওয়া যায়? পেরেছ তোমরা? ভালো করছে ওরা খুব ভালো। আমি ওদের পক্ষে আছি।’
যেন মৌচাকে পড়লো ঢিল। মুহূর্তে তার ওপর অন্য প্রৌঢ়দের হুল ফোটানো শুরু হলো। একজন বলল, ‘ও বুঝেছি, তুমি একাই বুদ্ধিজীবী। তুমি বুদ্ধির ঢেঁকিজানি না আমরা!’
সঙ্গে সঙ্গে এর খেই ধরে অপরজন, ‘তরুণদের ওপর বেজায় আস্থা তোমার তাই না? তোমাদের জন্য, এই তোমাদের মতো এদের জন্যই এই তরুণরা আজ উঠতে-বসতে বেয়াদবি করে।’
আগুন জন থেকে জনে সঞ্চারিত হচ্ছে দেখে রাজার মুখে কিছুটা ভ্যাবাচ্যকা ভাব। সুযোগটা হারাতে চাইল না কেউ।
‘যা করছে তাই যদি ভালো হতো তো তবে বন্ধু এসবের একটা ধারাবাহিকতা থাকত। কই কোনও কিছুর তো ধারাবাহিকতা নেই! আজ এটা তো কাল ওটা, কাল ওটা তো পরশু আরেকটা, একদিন সব তালগোল পাকিয়ে সব গিয়ে হারিয়ে কোনও কাজই আর দাঁড়ালো না। বাহ! এই তোমার তরুণ? এরা আজকের তরুণ, যত চোখশোভা কাজকর্ম করে, লোকদেখানো, নাম ভাঁড়ানো, জানি না এসব?’
‘কাজ দাঁড় করিয়েছি বলতে পার আমরা। কী দেখিনি! বাংলার স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্ম দেখেছি শত্রু তাড়িয়েছি। আর এরা তো হচ্ছে সব ক্ষমতাযন্ত্রের শিকার। বুদ্ধি খাটিয়ে কেউ কেউ শিকারি। এদের সেই আত্মাহুতির মন কোথায়! শিল্পের প্রতি সেই ডেডিকেশন কোথায় এদের? এ্যাঁহ, কাজেই কবিতা পোড়াতে এসেছেন তেনারা। আরে, জীবন আহুতি দিতে হয় জীবন।’ তরুণদের পক্ষে দাঁড়ানো প্রৌঢ় যেন একাই যুঝবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার মুখের বিব্রত ভাবটাকে পেটে চালান করে দিয়ে কণ্ঠে জোর এনে বলে উঠলো, ‘এই যে, এই যে তোমরা ধারাবাহিকতার কথা বলছিলে না? এই ছেলেমেয়েগুলো কবিতা পুড়িয়ে জীবন পোড়ানোর পাঠ নিচ্ছে না, জীবন আহুতির প্রস্তুতি নিচ্ছে না তা তুমি কী করে বলতে পারো? আসলে তুমি, এই তুমি, তোমরা, সব ক’টা বুড়ো হয়ে গেছ। ইশ্, জোয়ানকালে বুড়োদের গাল তো কম খাওনি। তখন জ্বলেছে আর এখন নিজেরাই বুড়ো সাজতে লেগেছ।শোনো, এদের প্রাণশক্তির কাছে শিক্ষা নাও, শিক্ষা। আর আস্থা রাখো, আস্থা। বুঝলে? তরুণদের ওপর থেকে কখনো আস্থা হারাতে হয় না।’
‘আস্খা রাখার পাত্রের অভাব হয়নি আমাদের। তোমার অভাব হয়েছে। তুমিই এদের ওপর আস্থা রাখো।’ এতক্ষণ বিতর্কে অংশ না নিয়ে শুধু এমুখ ওমুখ করছিণল মাথায় পাকা কোঁকড়া চুলের একজন। এবার ঠোঁটে দুই আঙুল ঢুকিয়ে তীক্ষ্ণ সিটি বাজিয়ে মুহূর্তে রাশ টানলো আলাপের। ‘ও বুড়োর দল! গাঁজায় দম দেওয়ার আগেই শুরু হয়ে গেল যত গাঁজাখুরি আলাপ!’
‘খবরদার! কে বলে বুড়োর দল কে! চুলে বুঝি মনে করে আজ খুব কলপ মাখিয়ে আসা হয়েছে, না?’
‘আচ্ছা ও ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। কতক্ষণ আর বৃথা বসে থাকব, ওই গাঁজা বেচা ছেলেটা আজ গেল কোথায়।’
‘আরে নাতির বেটার দেখাই নেই, শালা।’ একজন বলল, ‘সম্পর্কের নৌকা তো গাছে উঠেছে তোমার। মাতাল, সব মাতাল।’
আলাপের বিষয় গাঁজার দিকে ঘুরে গেল। চুলের কলপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে যার সে বলল, ‘ওহ আর যে পারি না। আমি কলাম শিবের সাধক, অ্যাকেবারে তাণ্ডব ঘটিয়ে দেব!’
পাশের জন টিটকারির সুরে বলল, ‘হে হে, শিবের সাধক বলেই বুঝি গেল বছর হজ করে এলে?’
অসহিষ্ণু কণ্ঠে কেউ বলে উঠল, ‘ধুর, কিসের ভেতর কী! ওই দেখ, বাবাদের আসর জমেছে।’
লোকটা আঙুল তুলে দূরের ছাউনি দেওয়া আখড়ার দিকে সবার নজর ফেরাল। ওখানে রংবেরঙের ঝুলজামা পরে জটাধারীরা এসে বসেছে। বাজছে দোতারা খঞ্জনি করতাল উড়ছে গাঁজার ধুম। খোলা গলায় গাইছে তারা কণ্ঠ ছড়িয়ে যাচ্ছে উদ্যানময়। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অফিসফেরতা কেরানি, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ, ঘরছাড়া ভবঘুরে, ভাসমান পতিতাদের মধ্যে ভাববাদী দুই-একজন। গাছপালা সেখানে ঘন। প্রৌঢ়দের মধ্য থেকে একটা দল আলাদা হয়ে সেদিকে চলল। যাওয়ার বেলায়বলে গেল একজন, ‘একটু গন্ধ শুঁকে আসি অন্তত। ক্ষুধার্ত তো অন্যের খাদ্য গ্রহণ দেখিয়াও আনন্দ পায়।’
তিন.
প্রৌঢ়দের দলটা থেকে পুব দিকেগাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জনাকয়েক তরুণ। তাদের চেহারা থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক দাঁড়িয়ে থাকা সব কিছুতেই নিজেদের ওপর অযত্ন অশ্রদ্ধার ভাব প্রবল বলে মনে হয়। প্রৌঢ়দের দেখিয়ে বয়েসের প্রসঙ্গ তুলে টিটকিরি ঝাড়ে, আবার নিজেদের যৌবন, এর পরিণতি এসব নিয়েও হতাশা প্রকাশ করে।
আগুনে কবিতা পোড়ানো বিষয়ে ওদের একজন মন্তব্য করে, ‘উন্মাদগুলোকে দেশ থেকে বার করে দেওয়া দরকার।’ অদূরের দৃষ্টি আকর্ষণ করল অদূরে ইট বিছানো রাস্তায় একটা নিসিন্দা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আলাপ করতে থাকা তরুণ তরুণীর ছোট এক দলের দিকে,ওরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিত্য দার্শনিক তত্ত্বকথা আওড়ায়। ওদের আলাপ আর কাজকর্মকেও ভণ্ডামির চূড়ান্ত বলে রায় দেয় এরা। এসব দার্শনিকতার আড়াল নিয়েমান বাঁচিয়ে নেশা করাটাই এদের মূল উদ্দেশ্য, এ সিদ্ধান্তে সবাই একমত হয়। কথায় ভিন্ন ভিন্ন আঞ্চলিক টানের ওঠে শোর।
একজন বলে, ‘যত ভণ্ডের দল। যদি তোরা দার্শনিকই হবি তবে দেশের এ দশা কেন? দেশের কী দশা তাই তো জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না।’
‘একেকজনের পোশাকের কী বাহার। ‘ফোকলোর’ ‘সাবলটার্ন’ আরও হাবিজাবি বুলি কপচাচ্ছে। চেহারাগুলো আর তার সঙ্গে এসব বুলিটুলি দেখে শুনে তো মনে হয় একেকজন অলৌকিক মানুষ, বাপরে। ভুল করে এই নোংরা পৃথিবীতে চলে এসেছে।’
‘দ্যাখ দ্যাখ, কথা বলতে বলতে আবার হাতও নাড়ে। হাত নাড়ে মাথা নাড়ে কত কিছু নাড়ে। মানুষের গভীরে ঢোকার কথা বলে, অথচ এদের একজনকেও দেখলাম না নিজেদের ছাড়া কখনো আর কারও সঙ্গে গল্প করতে, কথা বলতে।’
‘ওরা ছাড়া আর কেউ তো মানুষ না বুঝলি না? আর আমরা তো চামচিকা, মানুষের মতো দেখতেই বড়জোর। নাকি আসলে আমরা চামচিকাই দোস্ত! হতে পারে না- ডাইনি বুড়ি আমাদের অভিশাপ দিয়ে মানুষ বানিয়ে রেখে দিয়েছে?’
‘কী রে বাবা, গাঁজায় দম তো দাওনি এখনও তাতেই এতো? তোরা শালা পারিসও। আর আমার টানলেও কাজ হয় না।’
একজন আলাপের নতুন মোড়ে না এসে আগেরটিতেই দাঁড়িয়ে রইল, ‘দ্যাখ, সঙ্গে আবার মেয়েও আছে। এইসব ছুড়ি নিজেদের কী যে মনে করে! আছে শুধু রূপের বাহার, এছাড়া আরকি।’ তরুণ দার্শনিক আলাপচারীদের ওই দলটা যে আসলে তাদের চেয়ে সব দিক থেকে নিকৃষ্ট এ বিষয়ে আর কোনও উপপাদ্য প্রমাণিত হওয়া বাকি থাকে না। কেউ একজন খানিকক্ষণ আগের কথার মোড়টা ধরে এগোতে গিয়ে বলে, ‘এই জালাল বেটাকে পেলে আজকে পিঠের হাড্ডি ভাঙব।’
ডাইনিতত্ত্ব দানকারী তরুণ সুর করে গেয়ে উঠল, ‘ও গাঁজাধর গুপ্তকিশোর জালাল বাবা মোর। চামচিকেদের দিতে দেখা মর্জি হয় না তোর?’
চার.
উদ্যানের সীমানা দেয়াল ধরে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া ইট বিছানো নান্দনিক এ রাস্তার নাম প্যারিস রোড কেন দেওয়া হলো, এ নিয়ে চলছিল জোর আপত্তি প্রকাশসূচক আলোচনা। তরুণ তরুণীদের পরনে হাল ফ্যাশনের পোশাক, তাতে পশ্চিমা ছাঁচ স্পষ্ট। একজন এলোমেলো চুলের গুঁফো তরুণের পরনে শুধু পাঞ্জাবি ঢলঢল করছে। তাকে ওই দলটির ভেতর দেখাচ্ছে সবচেয়ে অনুজ্জ্বল। মাথায় থ্যাবড়ে থাকা টুপি পরে অনর্গল কথা বলে চলেছে মূল বক্তা। এঁর বলা কথার ভেতর, প্রতিটা বাক্যের গঠনে, শব্দের উচ্চারণে আলাদা একটা ভঙ্গিমা, পৃথক একটা ঢং যেন আছে, শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে কাজে আসে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
‘যা কিছু নিজের, তাকে অবজ্ঞা করতে শেখানো ঔপনিবেশিকদের প্রথম ও প্রধান কাজ। মগজে বাজার তৈরির প্রথম ধাপ এটা, প্রথম ধাপ, আই রিপিট। নিজের ভালো কোনও কিছুই নেই, এমন জ্ঞান করতে শেখানো একটা কৌশল ওদের। তোমার ভালো কিছু নেই, তোমার কিছুই ভালো নয়, সুতরাং তুমি এসো, এই নাও বৎস, তুমি আমাদেরটা নাও। এরপর প্রচারণায় ছড়িয়ে পড়ো, ঘোষণা কর, তুমি সেরা ছিলে না, এখন ওটা নিয়ে সেরা হয়েছে, হ্যাঁ। এই উপনিবেশ আমাদের ওপর যুগে যুগে এসেছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মগত উপনিবেশ একের পর এক, এগের আগে আরেক, আমাদের ওপর এসেছে। এক উপনিবেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটি এসে হানা দিয়েছে। বাঙালিকে আরও অন্ধকারের দিকে কিসে টেনে নিচ্ছে?’
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কেউ একজন ঔপনিবেশিকতার খেই ধরে বলল, ‘আমরা নিজেদের জিনিসে শ্রদ্ধাশীল। তাই আমরা সিগারেট না ধরিয়ে গাঁজার জন্য অপেক্ষা করছি। নির্ভেজাল মাদকের পছন্দে আমরা পুরোই স্বদেশি।’
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের গল্প ফেঁদে বসল। ওই শিক্ষক একদিন বাড়িতে স্বদেশি তরল পান করছিলেন। ওই তরুণ এসে শিক্ষককে দেখে ফিরে যাওয়ার সময় পেছন থেকে ডাক পড়ল, সঙ্গে গুরুর সঙ্গে মদিরাসঙ্গ নেওয়ার আদেশ। তরুণ তখন দুর্বল পরিপাকযন্ত্রের অজুহাত দিলো। মুক্তির যুক্তি বাড়াতে আরও জানালো খানিক বাদে তাকে ক্লাস নিতে যেতে হবে। মদিরাগন্ধ মুখে নিয়ে ছাত্রদের সামনে গেলে অসুবিধায় পড়ে যেতে পারে।
তরল শিক্ষক তখন বললেন, ‘শোনো, প্রকারান্তরে তুমি কী বোঝাতে চাইছ, তা আমি বুঝেছি।’
তুমুল প্রতিবাদ উঠলো তরুণের পক্ষ থেকে। শিক্ষক বলেন, ‘বেশ, আমাকে অবমাননা যদি তোমার উদ্দেশ্য না হয়ে থাকে, তুমি যদি সত্যিই ক্লাস নিতে যেতে বিব্রত বোধ করার ভয়ে মদিরাসঙ্গ নিতে না চাও, সেক্ষেত্রে তোমাকে একটা কথা বলি। চাইছ না কেন, বুঝেছি, সবই বুঝেছি। আমি ছাত্রদের বোঝাই, সে জায়গায় না বুঝলে কি এই আমার চলে বলো? চলে না। শোনো ছেলে, তোমাকে কথাটা বলি। তুমি যদি তস্কর হও, তো তোমার জন্য এটা বিষ মনে রেখো। আর তুমি যদি হও জ্ঞানী তবে অমৃত। এ কথার ওপর নির্ভর করে নিও সিদ্ধান্ত সব। যাও এবার, যাও!’
দ্বিতীয়বার ‘যাও’ উচ্চারণে এমনই মদমত্ত শক্তি ছিল পালিয়ে বাঁচতে হয়েছে।
একজন বলল, ‘এ কথা সব মাদকের ক্ষেত্রেই খাটে, শুধু তরল নয়। ওই দেখ’ গাছের গুঁড়ির দিকে আঙুল তাক করে দেখালো ওই তরুণ, ‘আমাদের দিকে সবসময় আড়চোখে তাকিয়ে থেকে কী সব বলে ওগুলো। প্রায়ই দেখি, মানে খবর পাই কোড জানতে চেয়ে ছিনতাই করে বেড়ায় বেটারা, বেশ্যার দালালিও করে। হল বাণিজ্য তো রীতিমতো উঁচুদরের ব্যাপার, বলাই বাহুল্য। বেশ্যার উৎপত্তি পরিণতি জানে না কিন্তু খুব দাবড়ে বেড়ায় বনে, আর ভাবে সবার চেয়ে ভানমুক্ত ওরা। মূর্খ বলব না ওদের মূর্খতা সাময়িক। ওদের একটা স্থায়ী গাল দেওয়া দরকার।’
‘তস্কর, তস্কর। ব্যাটারা ওটাই। আমাদের মতো একই বস্তুর জন্য অপেক্ষা করছে। জানে না ওদের জন্য তো বিষ!’
মূল বক্তার আড়ালে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোন চাপতে থাকা এক তরুণ মুখ তুলে বলল, ‘শোনো, মহাত্মা গান্ধীর ‘আত্মকথা বা সত্যের প্রয়োগ’ পড়েছ? ওটার ভূমিকায় আছে সাধারণ মানুষ যে ভাষায় বোঝে সে ভাষাতেই তিনি তার তত্ত্ব, প্রয়োগ এসব বর্ণনা করবেন সঙ্গে নিজের কথাও বলবেন। কিন্তু বলবার ফাঁকে যদি ন্যূনতম অহমও প্রকাশ পায় তাহলে পাঠক যেন বুঝে নেয় তার সাধনা বিফল হয়েছে। এই যে তুমি ওদের তস্কর বলে নিজেকে জ্ঞানীর জায়গায় দাঁড় করালে।’
‘শোনো, তুমি গান্ধীর আত্মকথার কথা বললে বেশ কথা। কিন্তু সঙ্গে শামসুর রাহমানের ‘কালের ধুলোয় লেখা’ও পড়ে নিও। এখানে সত্যের দাবি বলে একটা শব্দ আছে কবি বিশেষভাবে ব্যবহার করেছে। সত্যের দাবি থেকে বলতে হয় এমন অনেক কিছু বলেছেন। আর ওই বলায় এমন অনেক কিছুও ছিল যেসব অহম বলে ভুল হতে পারে কিন্তু ওসব সত্যের দাবি, প্রমাণিত। যেমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে আমার বর্ণনা এভাবে না করলে তো বোঝাতে পারব না। সত্যের দাবি এটা বুঝলে?’
‘যা বুঝেছি, তা হলো শামসুর রাহমান ভুলে পাঠকের হাতে পড়েছেন।’
তার্কিক তরুণ পাল্টা বললো, ‘ঠিক যেমন গান্ধী।’
তরুণীটি হাত তুলে তুলে দু’জনকে থামিয়ে বললো, ‘শোনো, ওই গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বকাবাজি করছে যারা ওরা বিষের জন্য অপেক্ষা করছে কথা সত্য। ব্যবহারিক সত্য। তবে আমরাও যে অমৃতের জন্য অপেক্ষা করছি ব্যাপারটা তা নয় আর এটা তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দু’ভাবেই সত্য। ‘বাহ। তোমার প্রথম বাক্যটা আমাদের সঙ্গে সঙ্গত নয়। তবে দ্বিতীয় বাক্যটার কারণে তুমি উৎরে গেলে। কামাল ভাইয়ের একটা কথা আমি ভীষণ মানি। অবশ্য এটা প্রাকৃতজ্ঞানের কথা, কামাল ভাইয়ের মৌলিক কথা নয়, এরপরও আমি তার কাছেই শুনেছি বিধায় তার নামই বললাম। মূলত সবার অবস্থান কাঠগড়ায়। বিচারকের আসনে কেউ নেই।’
একজন বলল, ‘এটা আবার বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। সবার অবস্থান কাঠগড়ায় হলে মুক্তকণ্ঠে স্লোগানটা তুলবে কে! আর বিচারকের আসনে তাহলে কে? ঈশ্বর? সেও এক আকাশের কুসুম প্রকল্প বাবা! কাঠগড়ার রূপকল্প তুমি এনেছ যখন, বিচারকের আসনের রূপকল্পটাও তোমাকে আনতে হবে। আনলে বল কে, ওই আসনে কে।’
আড়ালের তরুণ শেষ বাক্যটা নজরুলের ‘এতো জল ও কাজল চোখের’ সুর বসিয়ে বেসুরে গাওয়ার পর আলাপনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঈশ্বর থেকে এলো অসুর, অসুর থেকে সুরে।সুর থেকে কণ্ঠে, কণ্ঠ থেকে সুরের ওঠানামায় গাঁজার প্রভাব বিষয়ে। গাঁজার প্রভাব থেকে আলাপ এলো এর ধর্মপন্থী প্রয়োগের সূত্র ধরে শ্মশান ঠাকুরে। শ্মশান ঠাকুর থেকে শাক্তবাদে, শাক্তবাদ থেকে পুরাণ- পুরাণ থেকে আদি ভারতবর্ষ- আদি ভারতবর্ষ থেকে বংশানুক্রমিক আদি শ্রমবিভাগ- তা থেকে এ বিষয়ে মার্কসের ভারতবর্ষ সম্পর্কীয় ধারণা, সেখান থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ থেকে আলাপ শেষমেষ গড়ালো যতীন স্যারের পড়ে যাওয়া দাঁতের হাসিতে।
এ সময় থ্যাবড়া টুপির প্রথম তরুণ জোর কণ্ঠে বললো, ‘আখড়ায় শব্দগানের আসর বসেছে, চলো। ওখানে গুপ্তজ্ঞানের বাজার বসেছে চলো চলো। ওই বাজার দখল করি। জালালের অপেক্ষায় সময় নষ্ট না করে বরং তাকে কাজে লাগানো যাক।’ ‘ওটা তো সবসময় বসে। এরচেয়ে চলো ওই কবিতা পোড়ানো উৎসবে যাই। মনে হয়, নতুন কিছু হচ্ছে। সবসময় তো এসব দেখা যায় না।’ ‘কে বলে? এসব লেগেই আছে। বরং সবসময় যুতের জাতের গাতকই বরং আসে না।’ তরুণীটি বলল, ‘ঠিকাছে বাবা, কেউ তাহলে ওদিক হয়ে সেদিক যাও, আর কেউ সেদিক হয়ে ওদিক যাও। সংকেত পেলে চলে এসো, এই হলো কথা।’
পাঁচ.
কাঁধে রাইফেল পায়ে বুট— তিনজনের একটা দল উদ্যানের অপর পাশে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। এদের একজনের নাম নূর, ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো—‘এই যে উদ্যানে সন্ধ্যার পর এইসব অসামাজিকদের গাড্ডা বসে, ইচ্ছে করে লাঠিপেটা করে সবক’টাকে গাড়িতে তুলে দিই এরপর যা হয় হোক। যতসব চোর-ছ্যাঁচড় আর ভণ্ডের দল জোট পাকিয়েছে।’ কথায় বরিশালের টান বেশ শক্তিমত্তা নিয়ে উপস্থিত।
কথা শুনে পাশের হাফিজ মুখ টিপে হাসতে থাকে আর সমর্থনে মাথা দোলায়। কিন্তু পাশের জনই মাথা নাড়ে, নূরের কথা মানতে সে রাজি নয়। তার নামপাতে লেখা, বাবুল।
কণ্ঠে কিশোরগঞ্জের টানে বাবুল বলেসন্ধ্যার পর মানুষের এই যে মেলা বসে দেখে কাতর হয় তারমন। ‘গ্রামের হাটের কথা হাটের আড্ডার কথা মনে পড়ে যায়। এমনই টুকিটাকির দোকান কত রঙের মানুষ, আড্ডায় এমনই গান গল্পের মজমা বন্ধুদের কত রঙ্গ, এমন খাদ্যখানার ঘ্রাণ, সব মিলিয়ে পরিবেশের মেজাজটা থাকত ঠিক এরকম।’
পথের ওপর পড়ে থাকা একটা ইটের টুকরো পায়ে সরিয়ে বলে,‘নেশারুদের দুটো দল ছিল সব কালেই। একদল ভবের নেশায় নেশা করে,আরেক দল করে ভাবের নেশায় নেশা। এখানে ভাবের নেশারুরা বেশি ভবের নেশারুরা কম। এই ভাবের নেশায় যে না-মজেছে তার পক্ষে বোঝা সম্ভব না।’ নূরকে উদ্দেশ করে বলে-‘তুই যেভাবে বলছিস যেনসব ভণ্ড তুই হাতে টিপে চিনেছিস। সম্ভব না বন্ধু। এখানে চোর বাটপার বেশ্যার দালালরা আছে সত্য, কিন্তু শিল্পী বাউল এরাও আছে।ভাবের লোকের আনাগোনা। ওই যে শোন, ওখানে একটু গিয়ে দাঁড়াও। দেখেও না দেখার ভান করি আমি বিশেষ কিছু বিষয়।ওপরের কথায় কত খারাপ কাজ দেখেও তো অমন ভান ধরতে হয়, হয় না? কিছু না কিছু তুইও পাবি শুনে দ্যাখ। নেশা করলেই সব ইতর ভণ্ড হয় নারে কালা, আমার কথা শোন।’
‘ইশ খুব নেশারু-প্রেমিক’, নূর প্রতিবাদ করে ওঠে।‘আমার কয়টা কথার বিপরীতে তিনি কয়টা বললেন, প্রেম উপচে পড়ছে আরকি। আমার কিছু পেতে হবে না বাবুচান! আমি যা বলেছি তা জেনে বুঝেই বলেছি। এখানে নিত্য সন্ধ্যা কাটাতে হয় এই আমিই জানি। এসব ভাবের কথায় কাজ হয় না মনি। আর ওই ভবের নেশারুরা এখানে ক্যাম্পাসে যত নষ্টের গোড়া। দেখিতো, সবই দেখি। আর এই সব বাউলদের আবোল তাবোল বকায় কি দুনিয়া চলা দূরে থাক পেটও চলে? পেট যেটুকু চালায় ওরা ভণ্ডামিতেই চালায়, দেখি না? সবই দেখি।’
হাফিজ এবারও সমর্থনে মাথা দোলাতে দোলাতে মুচকি হাসে। এই তার স্বভাব। দল ভারী হওয়ায় নূরের কথায় লাগে ক্ষমতার দগ। ‘পরের সপ্তাহেই ওপর থেকে নির্দেশ আসছে, কথা চলছে। তোমার এই মেলা আমি পিটিয়ে তুলে দেব। আর শুধু আমিই না। চাকরি যদি করো তো তোমাকেও এই কাজ করতে হবে বুঝলে মজনু? এখন থেকেই মন শক্ত কর।’
কথায় ঝিনেদার ঢেউ নিয়ে মুখ খোলে হাফিজ। নূরকে উদ্দেশ করে বলে, ‘বুঝলি, আয়নায় দাঁড়ানো ছাড়া ওর মনেই থাকে না ও পুলিশ। বাদ দে আর পাগল ক্ষ্যাপাস না।’
বাবুলের মুখটা কিছুটা গুছিয়ে প্রতিবাদ করার মতো ভাষার অভাবে কিছুটা অপমানে থমথমে হয়ে থাকে।গতি কমিয়ে সে পিছিয়ে পড়ে খানিকটা।সামনে দাঁড়িয়ে দুলে দুলে হাসতে থাকে অন্য দু’জন।
ছয়.
আধভাঙা চিটচিটে টুল টেবিল আর চুরি করা বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে নিয়মিত বিরতিতে বসেছে ডিমপরোটা আর চা সিগারেটের দোকান। ওসব দোকানে শ্রমজীবী মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিসচেতন তরুণ-তরুণীদের ভিড়।
পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেনি যারা তারা নৈশকালীন হন্টনে এসে দূর থেকে তাদের দেখছে আর মাঝেমধ্যে কাছেপিঠে এসে আলাপ শুনছে। ছাত্রদের সবল কণ্ঠের প্রাবল্যে টিকতে না পেরে চা-টা খেয়ে চটজলদি উঠে পড়ছে দলছুট প্রৌঢ়দের কেউ অথবা অফিসফেরতা পথচারী মানুষ। বাড়ি যাবার কৌণিক পথ হিসেবে ওরা এই উদ্যানকে বেছে নিয়েছিল।
সিগারেটের নীল ধোঁয়া, গরম তাওয়া থেকে উঠতে থাকা তেলের ধূসর ধোঁয়া, ডিম ফেটানোর শব্দ, চায়ের কাটে রূপালি চামচের টুংটাং, ভাজা পোড়ার সিজল, ক্ষুধা উদ্রোকককারী ঘ্রাণ, তুমুল কথোপকথন, তর্ক আর মাথার ওপর রহস্যনামানো হলুদ গোলমাথা বাল্ব—চলছে প্রাণোৎসব।
হঠাৎ হঠাৎ কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে উদ্যানের নেড়ি কুকুর, জায়গা বদল করছে, কারও ধাত বুঝে জায়গা মেপে সরছে, কারও পাশে গিয়ে নাড়ছে বাঁকানো লেজ।
এক নীরব শ্রোতার কাছে এসে লেজ নাড়তে থাকা এক কুকুর একটা চকলেট কেক পেল। তাকে খেতে দেওয়া হয়েছে দেখে তার আরেক বন্ধু এসেও একইভাবে লেজ নাড়তে থাকল, সে পেল সিঙাড়ার এক টুকরো। একবার শুঁকে হতাশ হয়ে এদিক-ওদিক চাইল, হলুদ আলোয় ঝিকিয়ে উঠল চোখ, একজোড়া সজল চোখ।
এমন মাহেন্দ্রক্ষণে গলায় ঝোলানো বাদামের ঝাঁকা খুলে মাটিতে নামিয়ে বেঞ্চে বসে ডিম আর ডবল পরোটার ফরমাশ করল এক কিশোর আরপেয়েও গেল চটজলদি। এক কামড়ে গরম ডিমপরোটার প্রায় অর্ধেকটা কেটে নিয়ে চিবুতে চিবুতে ভিড় মাপতে লাগল। মোটের ওপর দেখে নিলো বিশেষ কিছু দলের অবস্থান। পরোটা শেষ করে পয়সা বাকি রেখে উঠে দাঁড়ালো। টেবিল থেকে শ্যাওলা ধরা প্লাস্টিকের জগ এক হাতে তুলে নিয়ে গলায় ডগডগ করে ঢেলে দ্রুত মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে।
সাত.
যেন মাটি ফুঁড়ে উদিত হলো গুপ্তকিশোর। সবার আগে হাজির হলো তরুণ দার্শনিকদের দলটার কাছে। চটজলদি চুকে গেল লেনদেন।
এরপর গেল প্রৌঢ়দের দলটার কাছে। মৃদু হাঁক দিতেই বুড়োরা দিলো ঝাঁপ। দেখেশুনে সন্দেহ হতেই গাছে হেলান দেওয়া তরুণ ডাকুদের দলটা তড়াক করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, এরপর ছুট।
বুড়োদের সঙ্গে বিনিময় চুকিয়ে ঘুরতে না ঘুরতেই ঘাড়ের ওপর এসে পড়লো দলটা। মাথায় চাঁটি মেরে আগে এক পশলা গাল, এরপর শুরু হলো বাপ ভাই সম্বোধন। গাঁজা যা আছে কেড়ে নেওয়া হলো। এত অল্প কেন বাকি আছে আর—এই কৈফিয়ত চেয়ে আরেকবার চাঁটি। টাকা চাইতেই হাঁক।
ডাকুদের মুঠোয় কিছু প্রায় নেই বললেই চলে। সর্দার যে সে গুপ্তকিশোরের ঘাড় ধরে জটলার বাইরে বার করে দিলো। কে যেন আবার তাকে টেনে ঢোকাল জটলার ভেতর।
জট দেখে কবিদের একজন ওই নির্দিষ্ট জনের কাছায় মারলো টান। দেখে তৎপর হয়ে উঠল বাকিদের ক’জনাও। অতপর তিন কবি ছুটল জটের দিকে।
বাউল আখড়ায় দাঁড়িয়ে চোখ রাখতে থাকা ভীত ভবঘুরের দল একবার এগোতে লাগলো আরেকবার পেছাতে। সিদ্ধির জন্য মরিয়া আরও কয়েকটা দল ছুটে গিয়ে পেলো না কিছুই।
হিসহিসিয়ে চলতে থাকলো গালাগাল। একটা মারের শব্দ। বালকের চাপা কান্না।
আট.
পুলিশের হুইসেল একটা গুমোটে হাতুড়িপেটা করল। ইট বিছানো পথে বুটের শব্দ তুলে ছুটে আসতে থাকল পুলিশের ছোট দলটা। জট মুহূর্তে হালকা হয়ে ল্যাম্পোস্টের আলোয় অর্ধনগ্ন দেহটা পলকের জন্য দেখা গেল। যেন মন্ত্র পড়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল গুপ্তকিশোর।
একটু আগে সব কাজের কেন্দ্র ছিল যেখানে, সেখানে এখন জটলা বলতে কিছুই নেই। ক্ষুব্ধ পুলিশ, এদিক-ওদিক তাকিয়ে বৃথায় হুইসেল ফুঁকল বারকয়েক। কোথায় ঝাড়বে ক্ষোভ? এ নিয়ে চোখে চোখে হয়ে গেল সিদ্ধান্ত বিনিময়। অদূরে অগুন জ্বলছে দাউ দাউ, কাঠ পুড়ছে লটপট, চিটচিট পুড়ছে কবিতা। আগুনের সামনে আরক্ত কবিদের জট। অতি উৎসাহী নূর কবিতা পোড়ানো উৎসব লেখা ব্যানারসহ ইজেলটা লাথি দিয়ে ফেলে দিলো। ফিচেল হাসির হাফিজ আগুনের চারদিকে জড়ো লাল ধুলোয় পা ঘষটে বাতাসে চালালো লাথি। বাবুল হাতের লাঠি বাতাসে চালিয়ে দাবড়ে জট ভেঙে দিলো। তরুণরা ছিটকে সরে গেল কে কোথায়। দালালচক্র দ্রুত আত্মগোপন করে।
চোখ রক্তবর্ণ এক কালো তরুণ ব্যানার ফেলে দেওয়া পুলিশের সঙ্গে জুড়লো জোর তর্ক। অদূরে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজু চিবোতে থাকা একজোড়া তালেবুল এলেম একে অন্যকে ওদিকটা দেখিয়ে মুচকি হাসতে থাকলো। একজনের হাসির অর্থ—আচ্ছা শিক্ষা হয়েছে। নিষিদ্ধ তকমা আঁটা কিসের আকর্ষণে যেন অন্যজনের মন অপরাধী।
শান্তিপ্রিয় প্রেমিক-প্রেমিকার জোড়গুলো আপসে উদ্যান ত্যাগ করতে শুরু করলো। কবির রক্তচোখ এড়িয়ে যত ব্যবসাবাজকে বাতি নিভিয়ে বেরিয়ে যেতে চিৎকারে এদিক-ওদিক করতে লাগলো মারমুখী পুলিশ—‘দোকান তোল ব্যাটা, হঠ হঠ!’ উপর্যুপরি ‘যান যান, বোরোন সবাই’-এর তাড়ায় ছাত্র, সাধারণ, প্রৌঢ়দের দল ফটকের দিকে বাড়ালো পায়ের গতি।
আটটার কাছাকাছি বাজে। ধীরে ধীরে উদ্যানের আলোগুলো সব নিভে যেতে থাকল। বাউলদের গলার স্বর ধীরে খাদে নেমে এলো। নূর তাদের দিকে দাবড়ে যায় বটে, কিন্তু চোখে মুখে আধ্যাত্মিকতার ভয়।যদি ঠেকে যায়?
সাধুরা আপনাতেই সামলে ওঠেন। একজন দু’জন করে পুরোপুরি থেমে যেতে থাকেন। কুপির আলোয় সবার মৌন মুখভঙ্গিতে ঐশ্বরিকতা ভর করে।
হাফিজের ঠোঁট টিমটিমে বাতির মতো জ্বলে নেভে জ্বলে। বাবুলের চোখে ভক্তি। পিঠের অস্ত্র মাটিতে দাঁড় করিয়ে ওটা আড়াল করে সে দাঁড়ায়। একটা দোতারায় তখনও চলে পিড়িং-পিড়িং। ‘আপনারে আপনি তুমি হইয়ো সাবধান।’ এরপর সব থেমে যায়।