একটি শীত সন্দেহের কবিতা
তোমার চিরকালীন ঔদ্ধত্য খসে গেলে
আশ্চর্য প্রশ্নের অবসান হবে-এই ভাবনায়
শুরু হোক নীতিচর্চা, আরোপিত সন্দেহের বৃত্ত ভেঙে
বেরিয়ে আসুক পৃথিবীতে, একা একটা শীতকাল!
শীতকাল ফুটে থাকে কুয়াশাপ্রচ্ছদে,
শব্দে শব্দে লুট হতে থাকা নীতিকথায় আঁচড় কেটে
মানুষ তবু খোঁজে শীতের স্মারক!
উষ্ণতার মর্মছায়াতলে-প্রতিবিম্বশরীর!
শীততাড়িত মানুষ যৌবন গড়িয়ে পা রাখে অবশেষে
পড়ন্ত শয্যায়, মিটিয়ে জীবনের দায় ও দেনা
যুবতীনিদ্রার চৌকাঠে তবু যে সম্ভ্রমের গীত জাগে
কালক্রমে তা-ই হয়ে ওঠে জীবনের স্মৃতিসান্ত্বনা!
যৌবনে উদ্ধত মানুষ-
গোধূলিনৃত্যের দৃশ্যপরিকল্পে দাঁড়িয়ে
শীতকেও মাঝে মধ্যে সন্দেহের চোখে দেখে!
হেমন্তের অর্কেস্ট্রা
সব পথ গন্তব্যে পৌঁছে না—এ জাতীয়
উপপাদ্য নির্মাণের প্রস্তাবনা দীর্ঘায়িত হলে
যার অনুসিদ্ধান্ত নিরর্থকতা তৈরি করে
প্রতিরাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে একপ্রস্থ সঞ্চয়ী মুখ
অনুচ্চারে ডাকি তাই; যার সঙ্গে গাণিতিক কোনো
সম্পর্ক নেই; অথচ রাতের পৃষ্ঠাজুড়ে
সে বাজায় অন্যগ্রহে-হেমন্তের গোপন অর্কেস্ট্রা!
বিচিত্রমুখী না হয়ে যে পথ, ক্রমাগত
বহুগামী পোশাকে চিত্রিত করে নিজেকে
তার আড়ালের মধ্যবিন্দু কোনো সমীকরণ মানে না
এজন্য গোপনবিন্দুর পেলবতা ঢেকে যায় গাঢ় কুয়াশায়
হেমন্তের ভেজা ঘাসে জমে ওঠে বাষ্পীকৃত ভাবনা।
নদীর তলদেশ, পাহাড়চূড়া কিংবা মেঠোপথ ঘেঁটে
যে সম্ভাবনা পাখা মেলেছে ইতিহাসে
তার কিঞ্চিত সঞ্চয় করেছি ব্যাকরণসিদ্ধ সরলরেখায়
পথ আমাকে উপপাদ্য শেখায় প্রতিক্ষণ
নিরর্থকতা সত্ত্বেও যার ত্রিকোণে আমার বসতি;
যদিও ঘরামির ঘর জোটে না, কোনওকালে!
সাধক
খুব কাছে, নদীঘাটে কিংবা সরু গলির আসন্ন সন্ধ্যায়
স্মৃতিতাড়িত হয়ে ওঠে মুখরিত বিকেলগুচ্ছ
তখন পথ ভুলে যায় পাহাড়, আর গতিরোধক টপকে
দূরে সরে যায় নগরের অচেনা সাধক!
অথচ চাওয়ার ভেতরে কী এক অনিশ্চিত দ্বিধা তোমার
হাত বাড়ালে পাখা মেলে শূন্যতা, খুব গভীরে
জ্বলে ওঠে স্মৃতিময় অসুখ, যাকে তুমি আত্মমগ্নতা বলো!
মগ্নতায় কারো চোখ জ্বলে, মনও পোড়ে ভীষণ
কোনো প্রবোধ বাঁধতে পারে না তার অবারিত অশ্রুপাত
যদিও মানুষ তৈরি করে সমবেত পরিখা,
অবশেষে পতিত হয় তার পাঁকে, একা!
সবুজের স্বরলিপি
যে জীবন পেরিয়ে এসেছি, একদিন অনূদিত হবে তার ভাষা- পাশাপাশি এগিয়ে চলার দৃঢ়তা নিয়ে রচিত পাণ্ডুলিপি ইতিহাস চোখে তাকাবে, আমার শ্যাওলা মিশ্রিত সমাধি থেকে তখন যদি জন্ম নেয় কোনো অচেনা বৃক্ষ-তোমরা তার নাম রেখো সময়ের নামে। যদিও সময় একটি ধারণামাত্র-বয়ে যায়, মুছে ফেলা যায় না জীবন থেকে।
প্রতিদিন অজস্র সময় খসে যায় নভোমণ্ডলের তারকার মতো, আমিও খসে যাই, বাতাসে মিলিয়ে যাই, ধীরে। সময়ের বানানে তবু এক বিভ্রাট লেগে থাকে; যেন পাশাচক্রে শকুনির অভেদ্য চোখ! তাই, সময়ের সঙ্গে মিত্রতা হয়নি আমার, কোনোকালে!
তোমাদের চক্রব্যূহে আমি এক ব্যর্থ অভিমন্যু, জীবন পড়েও জীবনের দেখা পেলাম না! বাকিটুকু তোমাদের; পড়ে নিও, নিস্তব্ধতায় জেগে থাকা সবুজের অখণ্ড স্বরলিপি থেকে।
হেমন্তের শব
অনঙ্গ দিনের শেষে এইসব রাত নিয়ে আসে অন্ধকার ঢেউ। বিপুল নৈঃশব্দ্য থেকে ঝরে পড়ে কুয়াশা, প্রান্তরে শাদা চাঁদ। দেখো, চুম্বনক্লান্ত ভোরের মখমলে গতিশীল ঘোড়ার টগবগে ওড়ে লাল ধুলো। যখন নেমে আসে স্বেদ, পৃথিবীতে, আঁতুড়কান্না ভুলে থাকে মৌমাছি-ছানা, তখন কার কাছে ওই বন্ধকি ঠোঁট চুমুর আল্পনা শেখে?
পালকে পরাজিত সৌন্দর্য মেখে হিম হতে হতে সমর্পিত হই বৃত্তের ভেতর প্রতিদিন; চোখের আকাশ তবু আশা নিয়ে পাড়ি দেয় অফুরন্ত জিজ্ঞাসার মাঠ, প্রশ্ন তোলে-হলুদাভ পৃথিবীতে কেন এই নিঃসঙ্গ বাঁচা! তবু ডাকি-আয় গোপন, সোনামুখি দিনের খোঁজে উড়িয়ে দিয়ে প্রাজ্ঞ ফসিল; আয় দহন, ধুয়ে ফেলি ভরা হেমন্তে ঝরা শিশিরের ক্ষত!
চিত্রকল্প
অবচেতনের জল ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে মেঘ
কাশবনের ধার ঘেঁষে। নদীমহলের বিস্মরণ থেকে
উঠে আসছে ইতিহাস-
—মানুষ ভীষণ পরজীবী!
গন্তব্যশিকারি তুমি-
অবদমনের ব্যাকরণ ঢেকে রাখো মেঘদলে
আর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে
ঝরিয়ে দাও শীতার্ত শ্লোক;
—মানুষ ভীষণ পরজীবী!
সময়ের ট্রেন চলে গেলে বহুদূর পথ—
অর্থহীন প্রত্যাবর্তন জীবনের বিস্বাদ-স্টেশনে!
প্রতিশ্রুতির স্রোত
সে আবেশ বহন করে চলে প্রতিশ্রুতির নদী, দূরপথে। স্খলন আসন্ন, হয়তো জেনে গিয়ে থাকবে মধ্যবর্তী ঢেউ কিংবা চোখ টান টান আকাশের প্রস্তুতি সংক্রান্ত যা কিছু মৌন খুলে যাবে মেঘের ইশারায়। আর ঝুলে থাকবে আলস্যমাখা বিকেলের শোকস্তব্ধ মন্ত্রণায়!
এই সঘন দীর্ঘশ্বাস চাই নি, তবু ঝড়ের কারসাজি নিয়ে ভেঙে পড়ছে বৃক্ষ ও-পাড়ায়; গোধূলিতে আঙুল ঠেকিয়ে ঢাকতে না পেরে যুক্তির গ্লানি! হয়তো সাহসের হাত ধরে ঝরে পড়বে একদিন অশ্রুত কথানন্দন; কেননা গোপনে সবাই চিরকালীন, অনুশোচনার খেলায় আমন্ত্রণ তুলে রাখে নদীর ভাঁজে। সূর্যাস্তের কনে-দেখা আলোয় একদিন তুমিই চেয়েছিলে আটপৌরে নদীজল, সত্যের পাথর কুড়িয়ে নাব্য হতে। তখন থেকে কল্পনার নদীগুলোয় দীর্ঘ বালিয়াড়ি, বয়ে চলেছে শুধু প্রতিশ্রুতির স্রোত।
সন্দিগ্ধ বর্ষায় ভাঙে জলকেলি
সব ব্যর্থ হয়ে যায়, এই জলকণা, এই দীর্ঘ ইতিহাস
মেধার মন্দির থেকে নেমে যায় রক্ত, লোহিতকণিকা
একাকী রাতের কাছে-এই অব্যক্ত হাওয়ায়
অবিরাম লতার কৌশলে ঝরে—জীবনের জল!
যে বোঝে তার কাছে তৃপ্ত হয় সব আরাধনা
ঘরের ভেতরে ঘর, ছায়ার ভেতর আলম্ব ছায়ামূর্তি
গোপন ভুবন এক-মুছে যায় উপভোগ্য সাজ
অন্ধকার নিবিড় হলে, অধিকৃত শব্দের গুঞ্জনে।
শেষ অঙ্কে, জ্বলে ওঠে কলঙ্কের ভাগ-বিপন্ন ইন্দ্রিয়
গভীর উত্তাপে বাড়ে কামনার বিষ, আরো একবার
নেমে যায় সুর-গভীর সন্তাপে,
বোঝে না পরাক্রম, বিশ্বাসী মৃদঙ্গ ও নূপুর!
এ জীবন যেন রক্তাক্ত চন্দনের ধূপ, নীলনদ এক
সন্দিগ্ধ বর্ষায় ভাঙে জলকেলি, দীর্ঘ আয়োজন।
আশ্চর্য বাতাসে বাজে
তোমাদের নদীতে বাইপাস দেখিনি কোনওদিন
অথচ জলের তরঙ্গে দোলে সময়ের পরিহাস
ভাঁজ করা স্বপ্ন নৃ-মুদ্রায় ঝরায় অসংখ্য রাত
আর হেসে হেসে গলে যায় প্রারম্ভিক শয্যায়।
এভাবে সরে যায় প্রতিটি বিন্দু-দৃশ্য থেকে
পার হয়ে আষাঢ়সঘন দিনের আলস্য
কিংবা বীজ থেকে সংগুপ্ত প্রাণের প্রণোদনা।
অবশেষে গোপন শুশ্রূষা কাঁদে শরতে-নতমুখে
যুগল অন্ধকার ছুঁয়ে অস্ফুট স্বর মিশে যায় স্রোতে
কে তবে ভেঙে দেয় যাবতীয় স্থাপত্যকৌশল, কিংবা
আশ্চর্য বাতাসে বাজে কোন দ্বিধা-পৃথিবীর পথে!
মেটাফর
ম্রিয়মাণ আলোয় ভেঙে গেলে নিঃশব্দ প্রতিচ্ছবি
উপাসনালয়ের নির্জনতা খুন হয় কঠোর বাৎসায়নে;
যারা আজও নিজেদের মানুষ দাবি করে, তাদের
কর্ণিয়া ঘিরে লাল পিঁপড়ের দল উত্তুঙ্গ নাচে আর
পাহাড়সমেত ভরসন্ধ্যা উড়ে যায় মেঘের শাসনে।
মিছিলফেরত মানুষ ছিল নদী-নির্মাতা, বনস্পতি ভ‚মে
মাটিবর্তী যোগফল খোদাই করে গড়েছে সভ্যতার বন্দর
এখন তালুতে বন্দি মরুমুদ্রা
প্রান্তবাসী তবু খোঁপায় গোঁজে নদীভ্রমণের রূপকথা!
মিছিলফেরত মানুষ এখন বসন্তের অথর্ব পুরোহিত
অবগাহনে খোঁজে একান্ত মরুজল!
একটি কবিতার জন্ম
কারো জানার কথা নয়, অভেদ্য কুয়াশার ওপারে
কোন রহস্য; তবু বলতে হবে-
সময়ের ভেতরেই যেন বোবা হয়ে আছে সময়
আচরণ আর পোশাকি শর্তে!
মানুষ বিভ্রান্ত এখন, অন্ধকার ছুঁয়ে-ছেনে নিঃশব্দ প্রেমিক
ক্রমেই সংখ্যাতীত হয়ে যাচ্ছে অপেক্ষার দিনগুলো
অনুভবে ঋতু বদলের সুর; স্থাপত্য ধ্বংসের
অরক্ষিত এই ভূমে শুক্রাণুও গিয়েছে স্বেচ্ছা নির্বাসন!
এখন প্রতিশ্রুতিও স্ববিরোধী। ভেতরে সংকীর্ণ মানবতা
অভিজ্ঞতা ছাড়া সব অর্জন হয়ে পড়েছে হাস্যকর।
অথচ সহজেই সাজানো যেত সাবলীল সাঁকো
আর অহিংস গৃহের ভিত।
কারো জানার কথা নয়, গর্ভের প্রথম সঞ্চয় আর
চেতনার ভার কেন তুলে দিয়েছি প্রকৃতির অনুমোদনে;
হয়তো আশ্চর্য হবে জেনে-
কেননা, সময়ের গহ্বর থেকে একদিন
গাত্রোত্থান ঘটবে পৃথিবীর মৌলিক কবিতার।
ডানা ভাঙা রোদ
তোমার মতো প্রেমার্ত স্পর্শ কেউ করেনি, চিবুক ছুঁয়ে বলেনি কেউ পাশে এসে বসো; এই গুমোট হাওয়ার রাতে দীর্ঘ অপেক্ষা ভেঙে নেমে যাও গভীরে-যেখানে জন্মান্তরের ওমে গাঁথা আছে যাবতীয় ক্ষুধা-তৃষ্ণার স্বরলিপি, অকৃপণ শিল্পের রসদ। চৌরাশিয়ার লঘু মূর্ছনায় সেধে নাও নিজস্ব সুর। স্বপ্নের স্বল্পদৈর্ঘ্য ইশতেহার মুছে ফেলতে ফেলতে আমি তলিয়ে যাই প্রতিদিন, তৃষ্ণার গাঢ় আলিঙ্গনে।
অবশেষে হাতের তালুতে দেখি পাতাঝরা শীত; ওমের অপেক্ষা নিয়ে বিভ্রম ছড়ায় অন্য কেউ। তবে কি দৃশ্যের ওপারে, তৃষ্ণাব্যস্ত রাতের দেয়ালে লেখা হলো আমারই নাম, অগোচরে?
ভোরের কুয়াশা ভেঙে পাখা মেলে নির্ভেজাল রোদ, আর সমার্থক হতাশায় ভেঙে পড়ে পাললিক ডানা তার-কবিতার সংশ্রবে।
বিড়ালনামা
ঘরে ঘরে নৈবেদ্য সাজাও, আমিও উচ্ছিষ্টভোগী
কোনওদিন গোপনে হয়তো খেয়েছি রাতের ক্ষীর
এখনও সময়ের ভিড় ঠেলে পাশের বেঞ্চিতে
হাড়ের ঘ্রাণ শুঁকি-যেন অবেলার বিজ্ঞ তপস্বী।
দুধের বাটিতে বসা মাছিদের পাহারায় রেখে
সাজিয়েছো তোমরা ষষ্ঠীর লিপি-বটের পাতায়
গণতন্ত্রী আমি, তুলে রাখি ভ্রমণের কথকতা
অবজ্ঞা-অবহেলায় ছুঁড়ে দেওয়া আমিষ-কাঁটায়।
নির্লিপ্ত হয়ে আছি, জপমন্ত্র ভুলে তা দিয়ে গোঁফে,
সকালের রোদে যত খুশি কুটকুট করে যাও
শেষ ভালোর জন্য হুলো স্বভাব দেখাতেই পারি
দেবলোকে নয় শুধু, মাটিতেও পূর্ণ অধিকারে।
সুরভিত অন্ধকার
অন্ধকার ঢাকনা খুলে উঠে এলে আলোর প্রস্তাব, তার চতুর্ভুজে দাঁড়িয়ে পাঠ করি সম্মিলিত মুহূর্তের দাঁড়ি-কমা। দেখেছি, এ জীবন যতিচিহ্নময়। কর্তব্য-অকর্তব্যের মাঝখানে, যখন খসখসে প্রতীক্ষায় কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে-তখন নিঃশ্বাসের জড়তায় পাল্টে যায় বিচ্ছেদবিন্দুর তাড়না। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন উচ্চতা থেকে ছিটকে পড়েছি বহুবার জীবনের পাদদেশে, আর সামর্থ্যরে প্রতিটি কণা ভেঙে গেছে প্রগাঢ় নৈরাজ্যে, সুতো ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে সমস্ত স্পর্ধা।
যেখানে প্রশ্রয় ছিল, সে পথ পার হতে পারিনি কখনও। একাগ্রতার মাঝে প্রাচীর তুলেছে অনিবার্য এক সত্য এবং সম্মোহন, তবু দেখো, অরণ্যের গুহা থেকে সামনে এসে দাঁড়িয়েছি-পুনর্বার।
এই ঘোর অপরাহ্ণে আর কোনও ছড়ানো-ছিটানো তৃণভূমি নেই; অথচ জীবনের ভূর্জপত্রে ঠিকই জেগে আছে সুরভিত অন্ধকার, উড়ে যাওয়ার দৃশ্য…
- হেমন্তের অর্কেস্ট্রা: বীরেন মুখার্জী, গ্রন্থমেলা ২০১৬, কবি প্রকাশনী, প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান, মূল্য: ১৪০ টাকা