শিক্ষার সঙ্গে মানুষের নীতিগত সম্পর্ক আছে কিনা বিষয়টি বোঝার জন্য সাধারণত একটি পর্যবেক্ষণ আমরা করে থাকি। তা হলো—শিক্ষা এবং নৈতিকতার ফলিত রূপটি অনুসন্ধান করা। এতে দেখা যায় শিক্ষিত লোকমাত্রই নীতিবান নন। খুব সহজেই ধারণা করা যায় এতে—শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক নেই। সমকালীন মানুষের শিক্ষা ও নৈতিকতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ড. আহমদ শরীফ বলেছিলেন, শিক্ষা এখন সোলেমানি আংটির মতো। ঘষা দিলে আলাদিনের দৈত্য আসে, এবং সব রকমের ইচ্ছা পূরণ করে দিয়ে যায়।
আহমদ শরীফের কথায় একটু শ্লেষ আছে। শিক্ষাকে বর্তমানে ইচ্ছাপূরণের চাবি বানিয়ে নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কহীন করে ফেলা হয়েছে বলেই তার কথা থেকে মনে হয়।
এটি নিয়ে পৃথকভাবে চর্চা হয় বলেই ‘শিক্ষামন্ত্রণালয়’ বা ‘শিক্ষাবিভাগ’ আছে। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত শিক্ষা শব্দটির জায়গায় স্থান করেনিয়েছে নতুন একটি শব্দ—প্রশিক্ষণ। যদিও শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যায়।
আমাদের মূল প্রশ্ন ছিল শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্কনির্ণয়। প্রথমে আমরা শিক্ষা এবং নৈতিকতা বুঝেনিতে পারি—তবেই বিষয়গুলো বিচার-বিশ্লেষণ করা সহজ হবে। প্রথমেই আসি শিক্ষা প্রসঙ্গে। কয়েক যুগ আগেও শিক্ষা ছিল একটি ক্রিয়াপদ। এর বিকল্প হিসেবে আমার ধরেনিতাম ‘শেখা’ নামের আরেকটি ক্রিয়াপদ। সবাই বুঝতো শিক্ষা মানে কোনো কিছু শেখা। বর্তমানে শিক্ষা ক্রিয়াপদ নয়; একটি বিশেষ্য। এটি সাহিত্য, পদার্থ বিজ্ঞান কিংবা রসায়ন শাস্ত্র শেখা বোঝায় না। দর্শন শাস্ত্র কিংবা সমাজবিজ্ঞানও বোঝায় না। শিক্ষা এখন শিক্ষকতা সম্পর্কিত একটি পৃথক বিজ্ঞান। এটি নিয়ে পৃথকভাবে চর্চা হয় বলেই ‘শিক্ষামন্ত্রণালয়’ বা ‘শিক্ষাবিভাগ’ আছে। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত শিক্ষা শব্দটির জায়গায় স্থান করেনিয়েছে নতুন একটি শব্দ—প্রশিক্ষণ। যদিও শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যায়।
আমরা যদি একটি মোমবাতি এবং একটি টর্চলাইটের ছবি বোর্ডে এঁকে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করি জ্ঞানের প্রতীক কোনটি? যেকোনো বয়সের শিক্ষার্থীই বলবে মোমবাতি। কেন মোমবাতি জ্ঞানের প্রতীক? কেন টর্চলাইট নয়? বেশ কিছু শিক্ষার্থী উত্তরে কয়েকটি কারণ দেখিয়েছিল। যেমন:
১. মোমবাতির আলো চতুর্দিকে ছড়ায়। টর্চলাইটের আলো শুধু একদিকে ছড়ায়।
২. মোমবাতির আগুনের শিখা জ্ঞানের চেতনা বোঝাতে পারে। টর্চলাইটের ফোকাস তা পারে না।
৩. একটি মোমবাতির আলো থেকে শত, হাজার, লাখ এমনকী কোটিসংখ্যক মোমবাতি আলোকিত করা যায়। কিন্তু একটি টর্চলাইট থেকে আরেকটি টর্চলাইট আলোকিত করা যায় না।
উপরের কারণ সবগুলোই সত্য। বিশেষ করে প্রথম এবং তৃতীয়টি বেশি গ্রহণযোগ্য। তাদের বলা হলো, যদি তাই হয়, তাহলে আমরা শিক্ষকতার দিক থেকে মোমবাতিকে বলতে পারি টিচিং এবং টর্চলাইটকে বলতে পারি কোচিং। শিক্ষার্থীদের দিক থেকে মোমবাতিকে বলতে পারি লারনিং এবং টর্চলাইটকে বলতে পারি ট্রেনিং। বাংলায় মোমবাতিকে বলতে পারি শিক্ষা—কারণ শিক্ষার জন্য প্রয়াজনীয় সবকিছু এবং সম্ভব হলে শিক্ষকনিজের অভিজ্ঞতা থেকে আরও কিছু শিক্ষা দেন। আর টর্চলাইটকে বলতে পারি প্রশিক্ষণ—কারণ প্রশিক্ষণ শুধু একটি ছোট বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা তৈরি করে দেয়।
শিক্ষা বলতে যদি ‘শেখা’ না বোঝায় তাহলে এই উদাহরণ দিয়ে লাভ কী? যদি শিক্ষা বলতে সাংবাদিকতা, গাড়ি চালনা, কিংবা সেনাবাহিনীর মতো কোনো পেশা বোঝায়, যদি শব্দটির অর্থের মুড বিশেষ কিছু বা বিশেষ্য বোঝায় তাহলে শিক্ষানিয়ে এত কথা বলার মানে হয় না।
ধর্মবোধ আর কর্তব্যবোধের পার্থক্যটুকুই তাহলে নীতি? অনেক প্রশ্ন করা যাবে, সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। বর্তমানে নীতি একটি পৃথক পাঠ্যবিষয়; শিক্ষার মতোই। নীতিশাস্ত্র দর্শন এবং মনোবিজ্ঞানের কাছাকাছি একটি পাঠ্য বিষয়মাত্র।
এবার আসি নৈতিকতা প্রসঙ্গে। নৈতিকতা বলতে আগে বোঝানো হতো ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্রের অংশ হিসেবে মানুষের একটি অপরিহার্য গুণ হিসেবে। এটি মানুষ অর্জন করতো ধর্মবোধ থেকে। কিন্তু জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট প্রথমে জানালেন, ধর্ম এবং নৈতিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। একজন ধার্মিক সৎ কাজ করে কোনো কিছুর আশায়। তার মনে হয়তো লোভ অথবা ভয় থাকে। কোনো কিছুর লোভে অথবা কোনো কিছুর ভয়ে মানুষ অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকে। কিন্তু একজন নীতিবান লোক সৎ কাজ করে বিবেকের তাড়না থেকে; কর্তব্য বোধ থেকে। ধর্মবোধ আর কর্তব্যবোধের পার্থক্যটুকুই তাহলে নীতি? অনেক প্রশ্ন করা যাবে, সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। বর্তমানে নীতি একটি পৃথক পাঠ্যবিষয়; শিক্ষার মতোই। নীতিশাস্ত্র দর্শন এবং মনোবিজ্ঞানের কাছাকাছি একটি পাঠ্য বিষয়মাত্র। এবং সমাজকর্ম বা সমাজকল্যাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি প্রয়োজনীয় বিষয় মাত্র। অর্থাৎ নীতিশাস্ত্রের তাত্ত্বিক দিকটি দর্শন এবং মনোবিজ্ঞানের বন্ধু। কিন্তু এর ব্যবহারিক দিকটি সমাজকল্যাণের আত্মীয়।
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে তবে কি আমরা নীতিবান হবো শুধু সমাজের কল্যাণের স্বার্থে? ‘সদা সত্য কথা বলিব’ শুধু সমাজের কল্যাণের জন্য! যদি কোনো সমাজে সত্য লুকিয়ে রাখলেই কল্যাণ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে ‘সদা’ সত্য বলার প্রয়োজন নেই? বরং সত্য লুকিয়ে মিথ্যা বলার প্রয়োজন আছে? যদি তা নাই হবে তাহলে নীতির অভাব কিংবা নীতির অন্য দিক অর্থাৎ দুর্নীতির কথা লুকিয়ে রাখার জন্য গণমাধ্যমগুলোর ওপর কোনো কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র এমন চাপ দেয় কেন? এমন কঠোর আচরণ করে কেন?
এবার তাহলে এসে যাচ্ছে আপেক্ষিক তত্তে¡র কথা। কল্যাণ একটি আপেক্ষিক বিষয়। এক ব্যক্তির কল্যাণ অন্যের জন্য অকল্যাণ হতে পারে। এক শ্রেণীর কল্যাণ অন্য শ্রেণীর অকল্যাণ হতে পারে। একটি গোষ্ঠী, দল, উপজাতি কিংবা জাতির কল্যাণ অপরের জন্য অকল্যাণ হয়ে উঠতে পারে। তাহলে নৈতিকতার আর স্থান রইল কোথায়?
২. চার্লস ডিকেন্স ও রবীন্দ্রনাথ
ইংরেজি সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক চার্লস ডিকেন্স (১৮১২০-৭০) সমাজেরনিচুতলা থেকে সমাজের উঁচুতলায় উঠেছেন শুধু কথাসাহিত্যের জনপ্রিয়তার মাধ্যমে। তার উপন্যাসের চরিত্রগুলো, বিশেষ করে শিশু-কিশোর চরিত্রগুলোতে তারই শৈশব-কৈশোর লুকিয়ে আছে। অনেকে বলেন সরাসরি তার শৈশবেরই প্রতিচ্ছবি। আর আছে তার ছোটবেলার পরিবেশে বেড়ে ওঠা প্রতিবেশী শিশু-কিশোররা। তাদের মধ্যে চোর, ছ্যাঁচোর, বাটপার, প্রতারক, ছিনতাইকারী, পকেটমার, ডাকাত ইত্যাদি নষ্টছেলের দল। তার উপন্যাসে আমরা ভালো চরিত্র পাই ডেভিড কপারফিল্ড, পিপ, অলিভার টুইস্ট প্রমুখকে। আর নষ্ট ছেলেদের মধ্যে…। ডিকেন্সকে ইংরেজি সাহিত্যের বাস্তববাদী কথাসাহিত্যিক বলা হয়। সে ক্ষেত্রে বলা যায় তার উপন্যাসে তুলে ধরা চরিত্র, সময় এবং ঘটনা সমকালীন সমাজবাস্তবতারই প্রতিচিত্র মাত্র।
আমরা যদি এভাবে মূল্যায়ন করি ডিকেন্সের সাহিত্যের সমাজ-বাস্তবতায় সমাজেরনিম্নবিত্ত বা বিত্তহীনদের মুক্তি ঘটে উচ্চবিত্তের উদার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ —এর ডেভিড, ‘অলিভার টুইস্ট’—এর অলিভার এবং ‘গ্রেট এক্সপেকটেশন্স’- ফিলিপ পিরিপ ওরফে পিপ এরা সবাই প্রলেতারিয়েত বা সমাজের নিম্নবিত্তের সন্তান। অনাথ,নিরাশ্রয় ইত্যাদি। তাদের দীর্ঘ বঞ্চনার ইতি ঘটে বুর্জোয়া শ্রেণীর সরাসরি হস্তক্ষেপে। তার উপন্যাসের বুর্জোয়া চরিত্রগুলো সত্যিকার অর্থেই বুর্জোয়া। ধন-সম্পদে ঋদ্ধ, উচ্চ শিক্ষিত, উন্নত রুচির অধিকারী, ব্যক্তিজীবনে সৎ এবং সামাজিকভাবে সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত পরিবারের।
সপ্তদশ শতকে (১৬৮৮ সালে) শিল্পবিপ্লব শুরু হয় যে দেশে সে দেশের প্রায় দেড়শ বছর পরের সমাজচিত্র অংকন করেছেন ডিকেন্স। এই সময়ে ইংরেজদের বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ স্থাপন, সম্পদ আহরণ,নিজেদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি এবং সমাজচিন্তা ও শিল্প-সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে মানব সভ্যতার একটি কেন্দ্রে পরিণত করে লন্ডনকে। সেই লন্ডনে গ্রাম থেকে উঠে আসা অনাথ বালকদের শ্রেণী উত্তরণের প্রক্রিয়াটি তুলে ধরাই যেন ডিকেন্সের সাহিত্যের মূল বিষয়-বস্তু। যা আমাদের কাছে রূপকথার মতো মনে হয়।
আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূলত ছোটগল্পেই শিশু-কিশোরদের প্রাধান্য দিয়েছেন। ১৮৯০ সালে পূর্ববঙ্গে জমিদারি চালাতে এসে তিনি গণমানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ লাভ করেন। এ সময় তিনি গ্রামের অনাথ, রুগ্ন, জীর্ণ, শীর্ণ, অপুষ্ট, অকাল বিধবা,নিরক্ষর, চরম দরিদ্র শিশু-কিশোরদের সচক্ষে দেখতে পান। এর আগে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে দেখেছেন রাজা-জমিদার অর্থাৎ বাঙালি উচ্চবিত্তের সামন্ত সমাজের লোকজন।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় ডিকেন্সের যুগে এবং তার কাছাকাছি সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতির এমননিম্নবিত্তের শিশু-কিশোরদের সমাজচিত্র অংকন করেছেন নানা সাহিত্যিক। যেমন স্কটিশদেরনিয়ে লিখেছেন রবার্ট লুই স্টিভেনশন, ফরাসিদেরনিয়ে লিখেছেন ভিক্তর হুগো, জার্মানদেরনিয়ে লিখেছেন এরিখ কেস্টনার, রুশদেরনিয়ে আলেক্সান্দার পুশকিন, ফিওদর দস্তয়েভস্কি, ম্যাক্সিম গোর্কি প্রমুখ। এদের সমাজ রূপান্তর শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে সমভাবে হয়নি বলে এখানে শুধু ডিকেন্সের সাহিত্যনিয়েই আলোচনা করা হচ্ছে।
আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূলত ছোটগল্পেই শিশু-কিশোরদের প্রাধান্য দিয়েছেন। ১৮৯০ সালে পূর্ববঙ্গে জমিদারি চালাতে এসে তিনি গণমানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ লাভ করেন। এ সময় তিনি গ্রামের অনাথ, রুগ্ন, জীর্ণ, শীর্ণ, অপুষ্ট, অকাল বিধবা,নিরক্ষর, চরম দরিদ্র শিশু-কিশোরদের সচক্ষে দেখতে পান। এর আগে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে দেখেছেন রাজা-জমিদার অর্থাৎ বাঙালি উচ্চবিত্তের সামন্ত সমাজের লোকজন। তাদের তিনি জন্মগতভাবেই চেনেন, ভালোভাবে জানেন। গ্রামের এসব শিশু-কিশোরকে দেখে তিনি তাদের ছবি এঁকে রাখলেন ছোটগল্পে। যতদিন তিনি পূর্ববঙ্গে থেকেছেন, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, রাজশাহীর পতিসর কিংবা সিরাজগঞ্জের সাহজাদপুর-কালীগ্রামে বোটে চরে গ্রামবাংলার প্রকৃতি দেখে লিখেছেন কবিতা, আর মানুষদের দেখে লিখেছেন ছোটগল্প। প্রায় প্রতিদিন তিনি ছোটগল্প লিখেছেন। এ সময়ের কিছু অতিপরিচিত ছোটগল্পের উল্লেখযোগ্য চরিত্র, যেমন: ‘পোস্টমাস্টার’-এর রতন, ‘ছুটি’-এর ফটিক, ‘সমাপ্তি-এর মৃণ্ময়ী, ‘আপদ’-এর নীলকান্ত, ‘অতিথি’র তারাপদ এরা সমাজেরনিম্নশ্রেণীর। এদের পরিণতি ডিকেন্সের চরিত্রের ঠিক বিপরীত।
ডিকেন্সের সন্তানরা পরিবেশ পরিবর্তন করে, এর পরে শ্রেণী উত্তরণ ঘটে। সমাজের উচ্চবিত্তের সরাসরি সহযোগিতায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই অনাথ সন্তানরা একইবৃত্তে ঘুরপাক খায় যেমন; নীলকান্ত এবং তারাপদ। শ্রেণী উত্তরণ তাদের ঘটে না। তাদের স্থান পরিবর্তন ঘটলেও তারা টিকতে পারে না যেমন; ফটিক। বড় ধরনের হোঁটচ খেয়ে আগের জায়গায় পড়ে থাকে যেমন; রতন। একমাত্র ব্যতিক্রম নদীভাঙা উদ্বাস্তু মেয়ে মৃণ্ময়ী—সে অপূর্বকৃষ্ণের মতো মধ্যবিত্তের হাত ধরে টিকে যায়।
বর্তমাননিবন্ধের আলোচনার বিষয় সাহিত্য নয়; সমাজবাস্তবতা। ডিকেন্সের লন্ডনে আজ সেই অনাথ বালকেরা এক টুকরো রুটির জন্য প্রবল শীতে খালি গায়ে, খালি পায়ে উ™£ান্তের মতো দৌড়ায় না। তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। খল চরিত্রগুলোও এখন আর লন্ডনে দেখা যায় না। আগের সেই চোর, ছ্যাঁচোর, বাটপার, প্রতারক, ছিনতাইকারী, পকেটমার, ডাকাত ইত্যাদি নষ্টছেলের দলকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের যেমন শ্রেণী উত্তরণ ঘটেছে, তেমনি নৈতিকতারও পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের ব্যক্তিগত দুর্নীতি সেখানে একেবারেই কমে গেছে। রাজনৈতিক বা অন্য ধরনের বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে থাকতে পারে।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের দেশে অনাথদের কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটেনি। শ্রেণী উত্তরণ তো ঘটেইনি। বরং দিনে দিনে স্বল্পপুঁজির গৃহস্থরা এখন ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়েছে। যদিও এদেশে ডিকেন্সের দেশের মতো উচ্চবিত্তের ব্যাপক হারে বিকাশ ঘটেছে। ঢাকা-কলকাতা সবখানেই লন্ডনের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। শিক্ষার হারও বেড়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থারও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কিন্তু রতন, মৃণ্ময়ী, নীলকান্ত, ফটিক ও তারাপদদের মুক্তি আসেনি। বরং আজ তাদের সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকা-কলকাতার মতো মহানগর থেকে শুরু করে গ্রামবাংলার সবখানে আজ তাদের দেখা যায়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে এই লোকদেখানো, চোখধাঁধানো উন্নয়ন কাদের জন্য? কেন এখানকার উচ্চবিত্ত শ্রেণীটা চরম স্বার্থপরের ভূমিকায় আছে? তাদের উদার হস্তক্ষেপ নেই ডিকেন্সের উচ্চবিত্তের মতো! এ প্রশ্নের উত্তরটানিবন্ধের শুরুর প্রসঙ্গটাই আবার স্মরণ করিয়ে দেবে। কারণ একটাই, শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক এখানে রচিত হয়নি। এখানে শ্রেণী উত্তরণ আছে কিন্তু শ্রেণীসংগ্রাম নেই। আর সেই উত্তরণ নৈতিকতার সীমারেখার বাইরের কোনো কালো পথ ধরে হচ্ছে।
অনুষঙ্গক্রমে বলতে হয় পূর্বে উল্লিখিত ইউরোপের অন্য জাতির ক্ষেত্রেও একই ধরনের উন্নতি ঘটেছে। স্টিভেনশনের স্কটল্যান্ড, হুগোর ফ্রান্স, কেস্টনারের জার্মানি, পুশকিন-দস্তয়েভস্কি-গোর্কির রাশিয়া সব খানেই আজ বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছেনিম্নশ্রেণীর অবলুপ্তির মাধ্যমে। শ্রেণী উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নৈতিক উন্নতি ঘটেছে। তাই আজ স্টিভেনশনের ডাবলিনে জিম, ডেভিড বেলফোরদের হাহাকার নেই। হুগোর প্যারিসে জাঁ ভালজাঁদের এখন আর এক টুকরো রুটি চুরি করতে হয় না, বছরের পর বছর ধরে সে জন্য জেলও খাটতে হয় না। কেস্টনারের বার্লিন-বন-মিউনিখে এমিলের পকেটের টাকা চুরি হয়ে যায় না। পুশকিন- দস্তয়েভস্কি-গোর্কির মস্কো-পিটার্সবুর্গে স্টেশন মাস্টারের আশ্রিতা মেয়েটি এবং নেলিন কিংবা পাভেলদের চরম মানবেতর জীবন কাটাতে হয় না। খল চরিত্রগুলোকে এখন আর দেখা পাওয়া যায় না। প্রযুক্তি এবং প্রগতির উন্নতির সঙ্গে তাদের ব্যক্তিত্ব, চরিত্র এবং নৈতিক উন্নতি ঘটেছে।
কত কত আত্মপ্রশস্তি! আত্মবন্দনা!! ইউরোপীয় রেনেসাঁর পেছনে আরব সভ্যতার অবদান কেউ অস্বীকার করে না। একাদশ শতাব্দীর পরে ক্রুসেডাররা আরবে এসে জ্ঞানবিজ্ঞানের স্পর্শ লাভ করে। এর পরে তারা আরব চিন্তাবিদদের রচনাবলি অনুবাদ করে জ্ঞান চর্চা করে নিজেদের পুনর্জাগরণ ঘটায়। আরবরাও কখনো গ্রিকদের অবদান অস্বীকার করে না।
আর আশ্চর্যের বিষয় উত্তর ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান জাতিগুলো নরওয়েজিয়ান, সুইডিশ, ডেনিশ এবং ফিনিশদের পূর্ব পুরুষরা বার্বারিয়ান এজ বা বর্বর যুগের জন্মদাতা। এ অঞ্চলের ভাইকিংদের কথা কে না জানে! যারা সারা ইউরোপের মানুষদের বুকের রক্ত হিম করে দিতো। সেই ভাইকিং দস্যুদের দেশগুলো আজ আন্তর্জাতিক জরিপে শান্তি, মানবসম্পদ কিংবা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ এবং প্রশাসনের জন্য সারাবিশ্বে ইতিবাচকভাবে প্রথম সারির দেশ বলে হিসেবে পরিচিত। বিশ্বসভ্যতায় তাদের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য ছিল না কখনো। বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি কিংবা সমাজচিন্তায় তাদের আবিষ্কার চোখে পড়ার মতো নয়। অথচ আজ তারা সুসভ্য জাতি।
আর আমাদের ঐতিহ্যনিয়ে অহঙ্কারের সীমা নেই। এমন দেশটি কোথাও নাকি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সকল দেশের রানী আমাদের দেশ। সভ্যতার পীঠস্থান। কত কত আত্মপ্রশস্তি! আত্মবন্দনা!! ইউরোপীয় রেনেসাঁর পেছনে আরব সভ্যতার অবদান কেউ অস্বীকার করে না। একাদশ শতাব্দীর পরে ক্রুসেডাররা আরবে এসে জ্ঞানবিজ্ঞানের স্পর্শ লাভ করে। এর পরে তারা আরব চিন্তাবিদদের রচনাবলি অনুবাদ করে জ্ঞান চর্চা করে নিজেদের পুনর্জাগরণ ঘটায়। আরবরাও কখনো গ্রিকদের অবদান অস্বীকার করে না। ইবনে সিনা, গাজ্জালি, ইবনে তাইমিয়া প্লাতো-আরিস্ততলদের ঋণ স্বীকার করেন। এরও আগে স্বয়ং আরবের নবী জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে চীনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অহংকার করে বলেননি যে, জ্ঞান অর্জনের জন্য চীনারা আমাদের কাছে আসুক। তিনি চীনা সভ্যতার অবদানের কথাই স্বীকার করেছেন।
আর আমরা আত্মঅহঙ্কারে কারও ঋণ স্বীকার করব না। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও এ জাতি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।