সেলিম মাস্টার ভাবতেও পারেননি তার ভাতিজারা তাকে এমন ভাষায় গালাগালি করতে পারে।
এই ভাতিজাদের তিনি কোলে-কাখে করে মানুষ করেছেন। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ওদের তিনি যত্ন করেছেন। ভাই যখনই বলেছে, মিয়া ভাই, আইজ জামালের পেটটা মনে অয় খারাপ, কেমন পায়খানা করতাছে আর গন্ধওলা পাদ দিতাছে। তখনই তিনি হয়তো ঘামে ভেজা জামাটা আবার গায়ে দিয়ে সদর হাসপাতালে অথবা লঞ্চঘাটে ডাক্তারের দোকানে অথবা সুরেন্দ্র কবিরাজের বাড়ি নিয়ে গেছেন।
স্কুলের সময়টা ছাড়া আর যেকোনো সময় তিনি নিজের সন্তানদের চেয়ে ভাতিজা-ভাতিঝিদের সময় দিয়েছেন। বর্ষার গভীর রাতে সমস্যা হলে ঘাটলা থেকে নাও নিয়ে নিজে বেয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গেছেন কবিরাজ বাড়ি। সে অনেক দূরের পথ। তিন-চার ঘণ্টার মতো লাগত।
ওরা আজ জমির সীমানা নিয়া ঝগড়া করে এমন ভাষায় কথা বলছে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। দোষ আসলে এতিম ভাতিজাদেরও না। কয়েকজন মান্যগণ্য লোক, এলাকার মেম্বার তারাই ভাতিজাদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে মাস্টারের বিরুদ্ধে। বিশ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি, এর মধ্যে আজ আছে ষোলো শতাংশ। এক দলিলে, চৌহদ্দি দেওয়া জমি। সালিশেরা তার চান্দি জমিন বিশ থেকে ষোলোতে নামিয়ে বলে তার আর মাত্র এক শতাংশ জমি পাওনা আছে গাড়ায়। যারা গাড়া ব্যবহার করছে, পায়খানার গু-মুতের ঢালা নামাচ্ছে, কলের পানি ঢালছে তাদের ভাগে না ফেলে মাস্টারের চার শতাংশ সদর রাস্তার পাশের দামি জমি থেকে কেটে নিয়ে গাড়ায় ফেলেছে—আবার বলছে সেখানেও এক শতাংশ পাওনা মাত্র। বাকি জায়গা কোথায় গেল! জিজ্ঞাসা করলে মাদবরেরা বলে, আপনের জায়গা তো কমই ছিল। কিছু জায়গা সদর রাস্তায় নিছে।
সেলিম মাস্টারকে ওরা সালিশি সভার নাম করে করে ঘুরিয়েছে বছরের পর বছর ধরে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। সদরের সব দপ্তরেই ধমক খাওয়ার চাকরি। কারো কাছে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস নেই। ছাত্রদের অনেকেই আজ উকিল। তাদের সামনে যেতে লজ্জা লাগে। কেউ কেউ হয়তো বিনা পয়সায় তার সমস্যার সমাধান করে দিবেনও। তার ছাত্রদের মধ্যে জজও আছেন অন্য জেলায়। তাদের জানালেও কাজ হতে পারে। কিন্তু জানাতে লজ্জা লাগে। চাকরির শেষ বছরে আর কারো কাছে যাবেন না। অবসর নেওয়ার পরে ছেলেরা যদি চাকরি-বাকরি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়, বিয়ে-শাদি করে তাহলে বাড়িতে ভালো মতো ঘর-দুয়ার তুলবে। এখন শুধু ভাঙাঘর আর বাইরের বেড়া দিয়ে বাড়ির জমিটুকু রক্ষা করা।
কতবার স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে সালিশী দরবারে বসেছেন; সমাধান ওরা করে দেয়নি। অথচ তার অনুপস্থিতিতেই অনেক সময় মাপামাপির কাজ সেরে ফেলেছে। তার বিশ্বাস—ওরা কোনো সত্য লুকাতে চায় বলেই তাকে নিয়ে বসে সমাধান করে না। আগে পরে সেরে ফেলতে চায়।
ভাতিজারা কয়েক বছর পরে এসে পাশের জমি কিনে বাড়ি করেছে। ওরা কিনেছে নয় শতাংশ কিন্তু দখলে আছে সাড়ে এগারো শতাংশের মতো। মজলিশে বসে দলিল দেখাতে বললে দেখায় না। এখানেই ঘাপলা। দখলের জমি বেশি কেন একথা জিজ্ঞাসা করলে কখনো বলে যে, পরে আরও আড়াই শতাংশ ওয়ারিশ কিনেছে। আবার কখনো বলে তাদের ওখানে জমি বেশি নেই। আবার বলে, মেপে দেখুক, বেশি হলে ছেড়ে দেবে। এমন সব বয়ান।
গ্রামের গণ্যমান্যদের সঙ্গে ভাতিজাদের খুব খাতির। থাকতেই পারে। কিন্তু ‘আমার সাথে যার কুস্তি তোমাদের সাথে দোস্তি’ এটা তো আপনজনের আচরণ না। মাদবরেরাই লাই দিয়ে ভাতিজাদের মাথায় তুলে রেখেছে। ভাতিজাদের নানাবাড়ির কোনো এক জমিনের অনেকটা অংশ যেটা নানাবাড়ির ওয়ারিশ হিসেবে পাওয়ার কথা; সেটা মেম্বার সাহেব দখল করে নিয়ে এখন চাচার জমি থেকে কামড় দিয়ে ভাতিজাদের খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
মাস্টার সাহেবের ছেলেরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে থাকে। কেউ টিউশনি করে পড়ে, কেউ কাজ করে প্রাইভেটে পরীক্ষা দেয়। বাড়িতে খুব কম আসে। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বাড়িতে ছোট মেয়ে রেশমাকে নিয়ে থাকেন। সে মাত্র ক্লাস টুতে পড়ে। আজ বাড়ির সীমানায় টিনের বেড়া লাগানোর সময় ভাতিজাদের মধ্যে ছোটটা—জামান বলে, তিন ফুট ছাইড়া বেড়া দেন।
ক্যান?
জিজ্ঞাসা করতেই বলে বাড়ির মাঝখান দিয়ে রাস্তা হবে। আগেই তিনফুট ছাড়তে হবে। সেলিম মাস্টার বলেন, আমার জায়গা বুঝে পাই নাই, কম আছে। রাস্তার জন্য ছাড়ি ক্যামনে? আর বাড়ির ভিতর দিয়া রাস্তা হবে ক্যান? রাস্তা তো পুকুরের পার দিয়া আছেই।
এ সময় আরও এক ভাতিজা কাঞ্চন এসে দাঁড়ায় ঘটনাস্থলে। সে বলে, বুইড়া, তোমার কব্বরের জায়গায়ও ঘাটতি থাকব।
কী বললি তুই কাঞ্চন? এই কি সারাজীবনের আদর-স্নেহের অবদান?
দুঃখে আর কথা বলতে ইচ্ছা করল না মাস্টারের। তিনি আর রা করলেন না। নীরবে মেয়ে রেশমাকে নিয়ে কাঠের খুঁটিতে টিন লাগাতে শুরু করলেন। ভাতিজারা দাঁড়িয়ে বাধা দিতে লাগল। গালাগালি শুরু করল। এক সময় ওরা মাস্টারের ছোট মেয়েকে থাপ্পড় মেরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। সাত বছরের মেয়ে রেশমা মাটিতে পড়ে গেলে মাস্টার দৌড়ে গিয়ে ওকে টেনে তুললেন। ভাতিজাদের কিছু বললেন না। শুধু জোরে জোরে চিৎকার করে আল্লাহর কাছে বিচার দিতে লাগলেন।
আল্লাহ তুই দেখিস। আমি কী দোষ করছিলাম পেটের ছেলেদের কাছে? আল্লাহ তুই তো জানিস ওদের জন্য সারাজীবন আমি কী করেছি। আমার এই মাসুম বাচ্চাটার গায়ে ওরা হাত তুলল। তুই বিচার করিস।
জামান, কাঞ্চন ওরা আরও বেশি গালাগালি শুরু করল। জামান বলল, তোমার শাপে একটা বালও পড়ব না। রাস্তার লাইগা তিন ফুট জায়াগা রাখতে কইছি রাইখা বেড়া দেন।
রেশমাকে নিয়ে সেলিম মাস্টার ঘরের দিকে ফিরে এলেন। কর্মস্থলেই পড়ে রইল শাবল, প্লায়ার্স, সাঁড়াশি, হাতুড়ি আর তারকাটা ভরা এনামেলের বাটি।
এ সময় উঠানে দেখা গেল এগারো বছরের একটি ছেলে। হাতে একটা কাগজ। সেলিম মাস্টারকে দেখেই সে সালাম দিল। সালামালাইকুম স্যার। স্যার আমি ফার্স্ট ডিভিশন পাইছি। এই যে স্যার রেজাল্ট কার্ড।
সেলিম মাস্টার ঘরের সামনে গিয়েও ঘরে না উঠে উঠানে দাঁড়িয়ে ছাত্রের হাত থেকে পাঠোন্নতির বিবরণ দেখতে লাগলেন। ছাত্রটি বলল, স্যার, স্কুলে আপনাকে খুঁজলাম। হেড স্যার বললেন, আপনি ছুটিতে আছেন। বাড়িতে কাজ। তাই নিজেই দেখা করতে এলাম।
সেলিম মাস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের বাড়ি জানি কোন গ্রামে?
ছাত্রটি বলল, স্যার পুরোহিত পাড়া।
অনেক দূর। সেখান থেকে এখানে আসতে অনেক সময় লেগেছে। ছেলেটার মুখটা শুকনা। মনে হয় এখনো দুপুরের খাওয়া হয়নি। মাস্টার ওকে ঘরে যেতে বললেন। ঘরে যাও। হাত মুখ ধুয়ে ভাত খাও। দুপুরের ভাত তো মনে হয় এখানো খাও নাই।
ছাত্রটি ঘরে গেল না। বলল, জ্বী না স্যার। আমি এখনো বাড়িতে যাই নাই। মারে রেজাল্ট দেখাই নাই। স্যার আপনার সাথে দেখা করতে আসলাম শুধু। আমার জন্য দোয়া করবেন স্যার। আমি যেন একদিন আপনার মতো একজন স্যার হতে পারি।
সেলিম মাস্টার তীব্রভাবে মাথা নেড়ে বললেন, না রে না। জীবনে স্কুল শিক্ষক হইস না।
ছেলেটি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে সে স্যারের পায়ে সালাম করতে এগিয়ে গেল। হঠাৎ সেলিম মাস্টার তাকে বাহু ধরে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবারে তাহলে জীবনে অনেক কষ্ট পাবি। তুই বড় কিছু হ।
বড় হওয়ার মানে না বুঝেই ছাত্রটি বিদায় নিয়ে চলে গেল।