বাস্তু ত্যাগী
দেউলে দেউলে কাঁদিছে দেবতা পূজারীরে খোঁজ করি,
মন্দিরে আজ বাজেনাকো শাঁখ সন্ধ্যা-সকাল ভরি।
তুলসীতলা সে জঙ্গলে ভরা, সোনার প্রদীপ লয়ে,
রচে না প্রণাম গাঁয়ের রূপসী মঙ্গল কথা কয়ে।
হাজরাতলায় শেয়ালের বাসা, শেওড়া গাছের গোড়ে,
সিঁদুর মাখান, সেই স্থান আজি বুনো শুয়োরেরা কোড়ে।
আঙিনার ফুর কুড়াইয়া কেউ যতনে গাঁথে না মালা,
ভোরের শিশিরে কাঁদিছে পুজার দুর্বাশীষের থালা।
দোল-মঞ্চ যে ফাটিলে ফাটিছে, ঝুলনের দোলাখানি,
ইঁদুরে কেটেছে, নাটমঞ্চের উড়েছে চালের ছানি।
কাক-চোখ জল পদ্মদীঘিতে কবে কোন রাঙা মেয়ে,
আলতা ছোপান চরণ দুখানি মেলেছিল ঘাটে যেয়ে।
সেই রাঙা রঙ ভোলে নাই দীঘি, হিজলের ফুল বুকে,
মাখাইয়া সেই রঙিন পায়েরে রাখিয়াছে জলে টুকে।
আজি ঢেউহীন অপলক চোখে করিতেছে তাহা ধ্যান,
ঘন-বন-তলে বিহগ কন্ঠে জাগে তার স্তব গান।
এই দীঘি-জলে সাঁতার খেলিতে ফিরে এসো গাঁর মেয়ে,
কলমি-লতা যে ফুটাইবে ফুল তোমারে নিকটে পেয়ে।
ঘুঘুরা কাঁদিছে উহু উহু করি, ডাহুকেরা ডাক ছাড়ি,
গুমরায় বন সবুজ শাড়িরে দীঘল নিশাসে ফাড়ি।
ফিরে এসো যারা গাঁও ছেড়ে গেছো, তরুলতিকার বাঁধে,
তোমাদের কত অতীত-দিনের মায়া ও মমতা কাঁদে।
সুপারির বন শুন্যে ছিঁড়িছে দীঘল মাথার কেশ,
নারকেল তরু উর্ধ্বে খুঁজিছে তোমাদের উদ্দেশ।
বুনো পাখিগুলি এডালে ওডালে, কইরে কইরে কাঁদে,
দীঘল রজনী খন্ডিত হয় পোষা কুকুরের নামে।
কার মায়া পেয়ে ছাড়িলে , এদেশ, শস্যের থালা ভরি,
অন্নপূর্ণা আজো যে জাগিছে তোমাদের কথা স্মরি।
আঁকাবাঁকা রাকা শত নদীপথে ডিঙি তরীর পাখি,
তোমাদের পিতা-পিতামহদের আদরিয়া বুকে রাখি ;
কত নমহীন অথই সাগরে যুঝিয়া ঝড়ের সনে,
লক্ষীর ঝাঁপি লুটিয়া এনেছে তোমাদের গেহ-কোণে।
আজি কি তোমরা শুনিতে পাও না সে নদীর কলগীতি,
দেখিতে পাও না ঢেউ-এর আখরে লিখিত মনের প্রীতি?
হিন্দু-মুসলমানের এ দেশ, এ দেশের গাঁয়ে কবি,
কত কাহিনীর সোনার সূত্রে গেঁথেছে সে রাঙা ছবি।
এদেশ কাহারো হবে না একার, যতখানি ভালোবাসা,
যতখানি ত্যাগ যে দেবে, হেথায় পাবে ততখানি বাসা।
বেহুলার শোকে কাঁদিয়াছি মোরা, গংকিনী নদীসোঁতে,
কত কাহিনীর ভেলায় ভাসিয়া গেছি দেশে দেশ হতে।
এমাম হোসেন, সকিনার শোকে ভেসেছে হলুদপাটা,
রাধিকার পার নুপুরে মুখর আমাদের পার-ঘাটা।
অতীতে হয়ত কিছু ব্যথা দেছি পেয়ে বা কিছুটা ব্যথা,
আজকের দিনে ভুলে যাও ভাই, সে সব অতীত কথা।
এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি, নুতন দৃষ্টি দিয়ে,
নুতন রাষ্ট্র গুড়িব আমরা তোমাদের সাথে নিয়ে।
ভাঙ্গা ইস্কুল আবার গড়িব, ফিরে এসো মাস্টার।
হুঙ্কারে ভাই তাড়াইয়া দিব কালি অজ্ঞানতার।
বনের ছায়ায় গাছের তলায় শীতল স্নেহের নীড়ে,
খুঁজিয়া পাইব হারাইয়া যাওয়া আদরের ভাইটিরে ।
প্রতিদান
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী,
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি।
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।
আমার এ কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
সে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান;
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি,
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ান ফুল-মালঞ্চ ধরি ।
যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে সখি, তারি মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত কি যে আনি, সাজাই নিরন্তর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
ধান ক্ষেত
পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সংকেত,
সবুজে হদুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের ক্ষেত।
ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে,
ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়ে পাখিগুলে শুয়েছে মাঠের পরে।
কৃষাণ কনের বিয়ে হবে, তার হলদি কোটার শাড়ি,
হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কটি রোদ রেখা নাড়ি।
কলমী লতার গহনা তাহার গড়ার প্রতীক্ষায়,
ভিনদেশী বর আসা যাওয়া করে প্রভাত সাঁঝের নায়।
পথের কেনারে মোর ধান ক্ষেত, সবুজ পাতার পরে,
সোনার ছড়ায় হেমন্তরাণী সোনা হাসিখানি ধরে।
শরৎ সে কবে চরে গেছে তার সোনালী মেঘের ছটা,
আজো উড়িতেছে মোর এই খেতে ধরিয়া ধানের জটা।
মাঝে মাঝে এর পকিয়াছে ধান, কোনখানে পাকে নাই,
সবুজ শাড়ির অঞ্চলে যেন ছোপ লাগিয়াছে তাই।
আজান গাঁয়ের কৃষাণকুমারী এইখান দিয়ে যেতে,
সোনার পায়ের চিহ্নগুলিরে গেছে এর বুকে পেতে।
মোর ধানক্ষেত, এইখানে এসে দাঁড়ালে উচচ শিরে,
মাথা যেন মোর ছুঁইবারে পারে সুদূর আকাশটিরে!
এইকানে এসে বুক ফুলাইয়া জোরে ডাক দিতে পারি,
হেথা আমি করি যা খুশি তাহাই, কারো নাহি ধার ধারি।
হেথায় নাহিক সমাজ-শাসন, নাহি প্রজা আর সাজা,
মোর ক্ষেত ভরি ফসলেরা নাচে, আমি তাহাদের রাজা।
এইখানে এসে দুঃখের কথা কহি তাহাদের সনে,
চৈত্র দিনের ভীষণ খরায় আষাঢ়ের বরিষণে।
কৃষাণী কনের কাঁকনের ঘায়ে ছিঁড়িয়া বুকের চাম,
এই ধানক্ষেত নয়নের জলে ভাসিয়েছি অবিরাম।
এইখানে বসে রাতের বেলায় বাঁশের বাঁশীর সুরে,
মোর ব্যথাখানি ছড়ায়েছি তার সুদূর কৃষাণ-পুরে।
এই ধানক্ষেত লুকাইয়া তার গোপন স্মৃতির চিন্,
দেখিয়া দেখিয়া কাটিয়া গিয়াছে কত না দীর্ঘদিন।
পথের কেনারে দাঁড়ায়ে রয়েছে আমার ধানের ক্ষেত,
আমার বুকের আশা-নিরাশার বেদনার সঙ্গেত।
বকের মেয়েরা গাঁথিয়া যতনে শ্বেত পালকের মালা,
চারিধারে এর ঘুরিয়া ঘুরিয়া সাজায় সোনার ডালা।
তাল বৃক্ষের উচু বাসা ছাড়ি বাবুই পাখির দল,
কিসের মায়ায় সারা ক্ষেত ভরি ফিরিতেছে চঞ্চল।
মাঝে মাঝে তারে জালে জড়াইয়া টেনে নিয়ে যেতে, চায়,
সকাল-সাঁঝের আলো-ছায়া-ঘেরা সোনালী তটের ছায়!
শিশির তাহারে মতির মালায় সাজায় সারাটি রাতি,
জোনাকিরা তার পাতায় পাতায় দোলায় তারার বাতি।