ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমি সম্মাননা পেলেন কবি শামীম রেজা। বাংলা কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য এ বছর তাকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়। গত ১৯ এপ্রিল সাহিত্য একাডেমি আয়োজিত ৩২তম বৈশাখী উৎসবে আনুষ্ঠানিকভাবে কবির হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কথাশিল্পী ও গবেষক নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ‘এ বছর সাহিত্য একাডেমি কবি শামীম রেজাকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে সাহিত্য একাডেমি বিশুদ্ধ কবিতাচর্চাকে উৎসাহেত করলো। কবি শামীম রেজা এসময়ের প্রধান কবি। তার কবিতা
বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।’
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন তরুণ কবি শরাফত হোসেন। তিনি বলেন, ‘শামীম রেজা ইতিহাসের সঙ্গে মিথ এবং বাস্তবতার সঙ্গে রূপকথা-উপককথার যোগসূত্র স্থাপন করতে গিয়ে যতটা কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন, ততটা অভিজ্ঞা থেকেও আহরণ করেছেন। একইসঙ্গে গ্রামীণ পটভূমি-শহুরে চিত্
রের সম্পর্ক স্থাপন করে দেখিয়েছেন, স্থানিক সীমারেখা ও সংস্কৃতি মানবজীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। ছন্দ-অন্ত্যমিল ও অনুপ্রাসের ক্ষেত্রে অরবৃত্তের চাল বজায় রেখে টানাগদ্যে প্রবহমান রেখেছেন প্রায় কবিতা। শামীম রেজার কবিতা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এই কবিকে সম্মাননা দেওয়ায় সাহিত্য একাডেমিকে আন্তরিক ধন্যবাদ।’
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে শামীম রেজা নিজের বেড়ে ওঠা, সাহিত্য চর্চার নানা দিক তুলে ধরেন।
সম্মাননাপ্রাপ্ত কবি শামীম রেজার কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন কবি-সমালোচক মোহাম্মদ নূরুল হক। তিনি বলেন, ‘‘নতুন ভাষা-সংকেত তৈরিই শামীম রেজার বড় কৃতিত্ব। আঞ্চলিক-কথ্য ভাষার সঙ্গে মান ভাষার সমন্বয় সাধন করে, নিজের জন্য তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র এক কাব্যভাষা। এই ভাষা-সংকেত তৈরির সময় তিনি ভুলে মনে রাখেননি পরিপার্শ্ব, এমনকি পূর্ববর্তী কোনো কবির ভাষাশৈলীও বিবেচনায় নেননি। আপন মনে দেবশিশুর মতো ভাষা নিয়ে খেলায় মতে উঠেছেন। শামীম রেজা স্বাধীন বাংলাদেশের সমানবয়সী। ফলে তার বেড়ে ওঠা, ওই সময়কার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বলয়ের সঙ্গে তাঁর গড়নেও কিছু প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ এক অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন। এরপর দেখেছেন সামরিক শাসন, সামরিক শাসকের পতন। উত্তর নব্বয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। মূলত কবি শামীম রেজার আবির্ভাবও এর পর থেকে। তাঁর কবিতা চর্চার শুরুর কালে অগ্রজরা মূলত উচ্চস্বরের কবিতা রচনায় নিবিষ্ট হয়েছিলেন।’
মোহাম্মদ নূরুল হক আরও বলেন, ‘সরাসরি বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকেই নিরূপিত ছন্দকে অস্বীকার করেছেন। বাদ দিয়েছেন, গীতিময়তাও। শামীম রেজার মানসগড়নও ওই সময়কে আবর্তিত হয়ে। ফলে তার কবিতার সময় একটি রাজনৈতিক বাঁকবদলের ইতিহাসকে আশ্রয় করে সৃষ্ট। কিন্তু শামীম রেজার রাজনৈতিক স্লোগনসর্বস্ব কোনো পঙ্ক্তি রচনা করেননি। আবার বাংলা কবিতার চিরায়ত রীতি, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত কিংবা স্বরবৃত্তকেও গ্রাহ্য করেননি। এভাবেও শিল্পচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গকে উপেক্ষা করেও তিনি কবিতায় সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, ‘কবিপ্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য’। কিন্তু আজকের যুগে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এই মতের ষোলোআনা অনেকেই মানবেন না। মানবেন না যে, এর কারণ, ‘একমাত্র’ শব্দ। তবে, আংশিক সংশোধন করে যদি ‘অন্যতম’ ধরা হয়, তাহলে বাংলা কবিতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে, তাতে কবিতার মানহানি ঘটবে না। কারণ, অতীতেও দেখা গেছে, কেবল ছন্দবদ্ধ হলেই তা কবিতা হয় না। বরং অনেক বিশুদ্ধ ছন্দে রচিত রচনাও শেষপর্যন্ত কবিতা হয়নি, হয়েছে ঝরঝরে সরল পদ্য। সুতরাং ‘একমাত্র’ অভিজ্ঞানকে কিছুটা ছাড় দিয়ে ‘অন্যতম’ করে নিলে শামীম রেজা কল্পনা, মনীষা ও অভিজ্ঞতার আশ্রয়ে সৃষ্টি করেছেন, উপস্থিতকাল ও যুগরুচির নিরিখে এর তাৎপর্য সীমাহীন।’’
সাহিত্য একাডেমির পরিচালক নন্দিতা গুহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও আলোচনা করেন আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সামসুজ্জামান, প্রাবন্ধিক হিমাদ্রী শেখর সরকার, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক অনিন্দ্য কান্তি বিশ্বাস, গবেষক মানিক রতমন শর্মা প্রমুখ।
এর আগে অনুষ্ঠানের সূচনাপূর্বে সঙ্গীত পরিবেশন করে সুর সম্রাট দ্য আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন ও আখাউড়া উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি। অনুষ্ঠানের শেষপর্বে নাটক ‘যুদ্ধ হয়নি শেষ’ পরিবেশন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাট্যগোষ্ঠী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সাইফুল ইসলাম রিপন।
উল্লেখ্য, কবি শামীম রেজার জন্ম ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ। এই পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো—‘পাথরচিত্রে নদীকথা’, ‘নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়ে’, ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’, ‘ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুল’ও ‘কবিতা সংগ্রহ’। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য এর আগে তিনি পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার।