২০১৬ সালে হলিউডে নির্মিত অ্যালেক্স প্রোয়াসের ‘গডস অব ইজিপ্ট’সিনেমাটি যারা দেখেছেন, তারা জানেন কিভাবে ক্ষমতা লাভের লোভে গড সেথ তার নিজ ভাই অসিরিসকে হত্যা করে, ভাইয়ের ছেলে হোরাসকে অন্ধ করে আটক রাখে। আর ‘বাহুবলি ২: দ্য কনক্লুশন’ সিনেমায় ক্ষমতা লাভের জন্য বল্লালদেব হত্যা করে তার চাচাতো ভাই অমরেন্দ্র বাহুবলি ও নিজের মা শিবগামীকে। ‘গডস অব ইজিপ্ট’ সিনেমাটির সঙ্গে তুলনায় ‘বাহুবলি-২’পিছিয়ে এটা বলিউড প্রেমিক কেউ মেনে নেবে না এটাই প্রত্যাশিত।
বাহুবলি-২ সিনেমাটিকে মাপতে হবে টলিউডের প্রথম সফল ভিএফএক্স এবং সিজিআই গ্রাফিক্স নির্ভর সিনেমা হিসেবে। এছাড়া বাহুবলির ইতিহাস যে তাৎক্ষণিক টাকার ইতিহাস, তা কারও অজানা নয়। ইতোমধ্যে ২৫০ কোটি রুপি বাজেটের অর্ক মিডিয়া ওয়ার্কস প্রোডাকশনের সিনেমাটির আয় ১৫০০ কোটি রুপি ছাড়িয়ে গেছে।
গত ১৬ বছর ধরে তেলেগু সিনেমাজগতের যে পরিচালকটি নানাভাবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়ে আসছেন, তিনি হলেন এসএস রাজমৌলি। সিনেমা নির্মাণের পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও পদ্মশ্রী পুরস্কার। রাজমৌলি বাহুবলি-২-এর সাহায্যে দর্শকের মন জয় করেছে মাগাধীরা কিংবা ইগার চেয়েও জোরালোভাবে। তিনি তার উচ্চাভিলাষের যে উপযুক্ত প্রতিদান পেয়েছেন তা বলতেই হবে। টলিউডের পরিচালক হয়ে তিনি এমন কিছু করে দেখিয়েছেন যেটি বলিউডের কোনো পরিচালক পারেননি। তাই আগামী দিনগুলোতে বলিউডের মহারথীরা যে নড়ে চড়ে বসবেন তা স্পষ্টভাবে ধারণা করা যায়।
কে ভি বিজয়েন্দ্র প্রসাদের অবদানে বাহুবলি-২ সিনেমাটির গল্পে যে খুব একটা আহামরি কিছু উঠে এসেছে, তা কিন্তু নয়। সিনেমার কাহিনী অনেকটা পৌরাণিক কাহিনীর মতো। খারাপের বিরুদ্ধে ভালোর জয় হিসেবে অনেকে গল্পটাকে দেখার চেষ্টা করছে।
শুরুটা এমন যে, রাজাবিহীন রাজ্য। রাজমাতা শিবগামী চাইছে তার নিজ পুত্র বল্লালদেবের পরিবর্তে মহেশপতির মহাবীর অমরেন্দ্র বাহুবলি মহেশপতির অধিপতি হোক। কিন্তু শিবগামীর স্বামী বিজালাদেব চাইছে তার নিজপুত্র বল্লালদেব মহেশপতির মহারাজা হোক। এই নিয়ে দ্বন্দ্বের শুরু। সিংহাসনে বসার আগে রাজ্য পরিদর্শন করতে গিয়ে বাহুবলি কুন্তলরাজ্যের রাজকুমারী দেবসেনার প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু এটা নিয়ে রাজ ষড়যন্ত্র শুরু করে বল্লালদেব।
ঘটনার পরিক্রমায় একসময় বাহুবলি রাজ সিংহাসন ত্যাগ করে। এছাড়া রাজমাতা শিবগামীর দৃঢ়তার কারণে বাহুবলিকে রাজপ্রাসাদও ত্যাগ করতে হয়।
অতপর কাটাপ্পা বাহুবলিকে হত্যা করে। রাজমাতা শিবগামী বাহুবলির সদ্য জন্ম দেওয়া সন্তান মাহেন্দ্র বাহুবলিকে মহেশপতির রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। বল্লালদেব ও বিজালাদেব এটা মেনে নিতে পারে না। শিবগামীকে হত্যা করে বল্লালদেব, তবে সৌভাগ্যক্রমে মাহেন্দ্র বাহুবলি রক্ষা পায়।
এরপর দেখা যায়, কাটাপ্পা এসব অতীত কাহিনী ২৫ বছরের যুবক মাহেন্দ্র বাহুবলিকে শোনাচ্ছে। মাহেন্দ্র বাহুবলি সব শুনে মহেশপতির প্রজাদের সঙ্গে নিয়ে বল্লালদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সবশেষে বল্লালদেবের মৃত্যু ও মাহেন্দ্র বাহুবলির সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমে এক মহাকাব্যিক ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে।
আসলে বাহুবলি-২ সিনেমাটি কী? প্রভাস, রানা ডুগ্গুবাটি, অনুষ্কা শেঠী, সত্যরাজ, নাসার এবং রামাইয়া কৃষ্ণণের অসাধারণ অভিনয়ের একটি ফলাফল বাহুবলি-২।
এটি কোনো প্রেমের কিংবা মিথ্যার ওপর সত্যের জয়ের গল্প নয়। এখানে প্রেমের জন্য বিসর্জন আছে সত্য, কিন্তু প্রেম গৌণ। রাজনীতি ও ক্ষমতা এখানে মুখ্য।
বাহুবলি-২ সিনেমাটিতে দুটি নারী চরিত্রের প্রাধান্য খুব বেশি। প্রতিবাদী নারীরূপে দেবসেনা বার বার প্রতিবাদ করে গেছেন রাজ্যের শাসনব্যবস্থার ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে। সিনেমাটিতে দেবসেনা সর্বত্র, সবসময় প্রতিবাদী নারী চরিত্র। সে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে শিবগামীর পাঠানো বিয়ের প্রস্তাব, বল্লালদেবের স্ত্রী হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে বাহুবলিই মহেশপতির শাসক হওয়ার একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি, রাজ্যের এক সৈনিক মেয়েদের শরীরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করলে তার আঙুল কেটে নিয়েছে। এক কথায় বাহুবলি-২ সিনেমাটিতে সেরা প্রতিবাদী চরিত্র দেবসেনা, অমরেন্দ্র বা মাহেন্দ্র বাহুবলি নয়।
অন্যদিকে রাজমাতা শিবগামীকে দেখা গেছে রাজ্যের সব ক্ষমতার অধিকারিণী রূপে। তিনি রাজ্যের সব প্রজাকে ভালোবাসেন, সবার কাছে শ্রদ্ধেয়া। তবে মুখের কথাই শাসন হওয়ায় তার স্বামী ও সন্তানের কুচক্রের কাছে বার বার হার মানতে হয়েছে তাকে। পুরো সিনেমাজুড়ে শিবগামীকে এমনভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে, যেন তাকে কোনো বিষয়ে দোষী না মনে হয়। তাই অমরেন্দ্র বাহুবলিকে হত্যার নির্দেশদাতা শিবগামী যখন শিশু মাহেন্দ্র বাহুবলিকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেন, তখন দর্শকেরাও শিবগামীকে মহিয়ষী এক নারীরূপে কল্পনা করেন।
কাটাপ্পা কেন মেরেছিল বাহুবলিকে—এই প্রশ্ন যাদের মনে দুই বছর থেকে ছিল। এখন তাদের জন্য প্রশ্ন, তারা কি তার উত্তর পেয়েছে? এর একমাত্র উত্তর রাজনীতি। ক্ষমতা লাভের ইচ্ছা পূরণের জন্য বিজালাদেব এবং বল্লালদেব যে চক্রান্ত করেছিল তা রাজনীতির এক প্রাচীন সংস্করণ। বল্লালদেব মহেশপতির অধিপতি হবার পর রাজ্যের জনপ্রিয় মহাবীর বাহুবলিকে সরিয়ে দেওয়ার নানা পরিকল্পনা রাজ ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। রাজপ্রাসাদ থেকে সরিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারে না বল্লালদেব, সে চায় অমরেন্দ্র বাহুবলির রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করতে। কাটাপ্পার মাধ্যমে সে আশাও পূর্ণ হয় বল্লালদেবের।
সিনেমাটিতে কাটাপ্পা ও বিজালাদেব চরিত্র দুটি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কাটাপ্পা চরিত্রটি একজন বিশ্বস্ত, দায়িত্ববান, শান্ত, প্রতিবাদী রাজকর্মচারীর প্রতীক। কাটাপ্পা অতি যত্নে বাহুবলিকে শৈশবকাল থেকে চোখে চোখে রেখে বড় করে তুলেছে। সেই কাটাপ্পা রাজমাতার আদেশে মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে তার প্রাণপ্রিয় বাহুবলির সামনে। মৃত্যুর আগে নাটকীয় এক মুহূর্তে কাটাপ্পাকে বাহুবলি বলেছিল, যতক্ষণ তুমি আমার সঙ্গে আছ, ততক্ষণ আমাকে মারার জন্য কারও জন্মই হবে না। অথচ তার কিছুসময় পরেই রাজমাতার আদেশ পালন করতে দ্বিধা করেনি কাটাপ্পা। শত কষ্ট পেলেও সে রাজমাতার আদেশ পালন করে। অথচ কাটাপ্পা যে সত্যিই বাহুবলিকে হত্যা করবে, এটা বল্লালদেবও বিশ্বাস করতে পারেনি। এখানেই কাটাপ্পার বৈশিষ্ট্য, এখানেই কাটাপ্পার আনুগত্য প্রকাশের শৈল্পিক উপস্থাপনা।
আবার মাহেন্দ্র বাহুবলি ও বল্লালদেবের যুদ্ধের সময়, কাটাপ্পাকে কৌশলী বিজালাদেব বলে অমরেন্দ্র বাহুবলির মতো মাহেন্দ্র বাহুবলিকেও হত্যা করতে। কিন্তু কাটাপ্পা তখন বিজালাদেবকে স্মরণ করিয়ে দেয়, রাজমাতা শিবগামী মাহেন্দ্র বাহুবলিকে মহারাজা ঘোষণা করেছিল।
বিজালাদেবের উচ্চাকাঙ্ক্ষা মূলত বল্লালদেবকে রাজ ষড়যন্ত্রে সবসময় উৎসাহিত করেছে। ছলনাময়ী বিজালাদেব দেবসেনার ভাই সহজ-সরল কুমার ভার্মাকে ছলনার ফাঁদে ফেলে বল্লালদেবকে হত্যা করতে পাঠায়। সেখানে বিজালাদেব ও বল্লালদেব কুমার ভার্মাকে হত্যা করে রাজমাতাকে জানায়, কুমার ভার্মাকে বাহুবলি পাঠিয়েছে। এটা মূলত করা হয় রাজমাতা শিবগামীর কাছ থেকে বাহুবলিকে হত্যার অনুমতি নিতে। এ রকম কুটিল ও জটিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আর কোনো ভারতীয় সিনেমাতে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে অমরেন্দ্র ও মাহেন্দ্র বাহুবলি সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। তারা দুজনই প্রায় একই বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ। মহাবীর, প্রেমিক, সত্যনিষ্ট, যুদ্ধজয়ী, জনপ্রিয় ও মাতা প্রিয় টগবগে যুবক বাহুবলি।
যেহেতু, মাহেন্দ্র বাহুবলি শিবগামীর ঘোষণা অনুযায়ী মহেশপতির অধিপতি। তাই নিজ সিংহাসন পুনরুদ্ধারের লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয় মহাবীর মাহেন্দ্র বাহুবলি। সে যুগের রাজনীতিতে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। সিনেমার শেষদিকে, বল্লালদেব কর্তৃক দীর্ঘদিন নির্যাতিত দেবসেনা শিবগামীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর মাহেন্দ্র বাহুবলি মহারাজা বেশে সিংহাসনে আসীন হয়ে শিবগামীর মতোই ঘোষণা করেছে, ‘এ মেরা বচন হে, মেরা বচনই হে শাসন।’
একথা দ্বারা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় রাজতন্ত্রের দুর্বলতা। রাজতন্ত্রের একজন মহান শাসকও স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এ যেন প্রাচীন রাজতান্ত্রিক সমাজের মহা ত্রুটি। শুধু একারণেই শিবগামীর চোখের জল বুকে শুকিয়েছিল কিন্তু অমরেন্দ্র বাহুবলিকে কাছে রাখতে পারেনি। একারণেই মাহেন্দ্র বাহুবলি সিংহাসনে বসলেও বিজালাদেবকে রাজ সিংহাসনের পাশেই দেখা গেছে।
সিনেমাটিতে অমরেন্দ্র ও মাহেন্দ্র বাহুবলি চরিত্রে অভিনয় করেছে টলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেতা প্রভাস। এছাড়া প্রধান খলচরিত্র বল্লালদেবের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রানা ডাগ্গুবাটি। এছাড়া অন্য চরিত্রগুলোতে যারা অভিনয় করেছে তারা প্রায় সবাই অভিনয়ে সমান দক্ষতা দেখিয়েছে।
বাহুবলি: দ্য বিগিনিং-কে সম্ভাবনার একটা প্রস্তাবনা ও বাহুবলি ২: দ্য কনক্লুশনকে একটি সম্ভাবনার সূচনা ধরা যায়। যার আবির্ভাবে ভারতীয় সিনেমা নতুন যুগের হাতছানি পাচ্ছে।
গাছের মাথায় উঠে গোলাকৃতির ড্রামের মতো হয়ে মহেশপতি রাজপ্রাঙ্গণে প্রবেশ প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে। এছাড়া বাহুবলি: দ্য বিগিনিং-এর শক্তিশালী চরিত্র অবন্তিকার এক রকম কবর রচনা করা হয়েছে বাহুবলি ২: দ্য কনক্লুশন সিনেমাটিতে।
বাহুবলি-২-এর ট্রেইলার