পর্ব-০৩
বাথের দরজা থেকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফিরে আসে সোফায়। বসে আয়েস করে মাত্রা। বুঝতে পারছে না ও, বিরক্তিটা কার ওপর? মানুষটা, অনাবিল আনন্দ না নিজের ওপর? লোকটা প্রকৃতপক্ষে সুবিধার নয়, মুখে ভদ্রতার মুখোশ এঁটে রেখেছে। কী এমন বলেছি আমি, যে রুম ছেড়ে চলে যেতে হবে? আমার কাছে টিকিটটাও নেই, ট্রেন চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছুলে কিভাবে বের হবো? আর যদি না ফেরে? শালা আমি বোকাচোদা, উচিত ছিল বাথে ঢুকেই টিকিট নিয়ে রাখা। কিন্তু কোন শালায় জানবে, মাঝপথে এমন ঘটনা ঘটবে? এই নাটকে আসাইটাই ঠিক হয়নি!
মোবাইল বের করে রবীন্দ্র সংগীত ছাড়ে, ‘মন মোর মেঘেরও সঙ্গী’। রবীন্দ্র সংগীতের সুরে ও মেঘের রেশে ঘুমিয়ে যায় মাত্রা মধুরিমা। মোবাইল বাজলে ঘুম ভাঙে তার। ডিরেক্টর রহমান লুসাইয়ের ফোন। দ্রুত মোবাইল কানে নেয়, হ্যালো?
উত্তেজিত গলা লুসাইয়ের, কী হয়েছে তোমাদের?
কী হবে, ঘুমিয়েছিলাম আমি।
ফোন দিচ্ছি তোমাকে পনেরো মিনিট ধরে, শুনতে পাচ্ছিলে না?
আমি শোনার সঙ্গে সঙ্গে তো ধরলাম।
অনাবিল ভাইয়ের কী হয়েছে? মোবাইলফোন বন্ধ কেন?
কার মোবাইলফোন বন্ধ?
অনাবিল ভাইয়ের।
আমি জানি না, উনি বাথের বাইরে গেছেন, হয়তো ঘুরতে।
তাই বলে ফোন বন্ধ রাখবে নাকি?
আমি কী করে বলবো?
ঠিক আছে, যা টেনশনে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত ফোন না ধরলে তো হার্টফেল করতাম। শোনো, এখন কোথায় আছ তোমরা?
আমি জানি না। জানালা দিয়ে কেবল গাছপালা বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে।
ইয়ে, অনাবিল ভাই রুমে এলে ফোন দিতে বলবে। আর তোমাদের জন্য চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে গাড়ি চলে গেছে। আমার যতদূর মনে হয়, এখন সাড়ে বারোটা বাজে, আর এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে। রাখি।
খিদে অনুভব করছে মাত্রা। হাই তুলে দরজার সামনে দাঁড়ায়, দুদিকে তাকায়। ট্রেনের বাটলার খাবার নিয়ে এই পথে আসা যাওয়া করে। একজন হকারকে দেখে, হাতে বিরাট একটা বস্তা। বস্তার মধ্যে হরেক রকমের চিপস, চানাচুর ডালমুড চিড়া ভাজা। চার ধরনের প্যাকেট কেনে রুমে এসে সোফায় বসে একটা চিপস মজা করে খাওয়ার পর পানি খায়।
আমি মানুষটাকে রেখে খেলাম? প্রশ্ন জাগে মাত্রা মধুরিমার মনে। আমি কী আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি? আমি তো এই মানুষটার লেখা নাটকের স্কিপ্টে অভিনয় করতে যাচ্ছি প্রধান চরিত্রে। আচ্ছা, কী বলেছিল বাবুটার বাবার চলে যাওয়ার পরে? সত্যি জটিল কিছু বলেছে? সত্যি কত নাটকে কত অভিনয়ে এই ধরনের দৃশ্য করেছি, ক্ষেপলাম কেন? আমার মধ্যে এই ক্ষেপামিটা যাবে না কখনো? আনন্দ সেই কখন রুম থেকে বের হয়ে গেছে, ঘণ্টাখানেক তো হবেই, না কি আরও বেশি, কোথাও কি বসার জায়গা পেয়েছে?
আমাদের জীবনের চারপাশে কত গল্প ছড়িয়ে আছে জবাফুলের মতো, বেত ফলের মতো, কাঁঠালিচাপার মতো, ব্যর্থ প্রেমের মতো, স্বার্থক ফোটা ফুলের মতো, কেবল কুড়িয়ে নিবি দুহাত ভরে।
একধরনের গ্লানিতে মাত্রা মধুরিমা অন্তর তিক্ত হয়ে ওঠে। টেবিলের ওপর রাখা রুমের চাবিটা নিয়ে বের হয়। রুম বন্ধ করে এগিয়ে যায় সামনের বগিতে। মুখটাকে যত সম্ভব ওড়না দিয়ে আড়াল করেছে, যাত্রীদের কেউ চিনে ফেললে ঝামেলা বেঁধে যাবে। প্রথম বগিতে পাওয়া গেলো না মানুষটাকে। দ্বিতীয় বগিতেও নেই। দাঁড়িয়ে আছে তৃতীয় বগির সামনে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, ঢুকবে না ফিরে যাবে? ট্রেনের যাত্রীদের কেউ যদি দেখে ফেলে! অবশ্য অধিকাংশ যাত্রী হয় ঘুমুচ্ছে না হয় মোবাইলফোন টিপছে।
এই বগিটা দেখে যাই, নিজের মনে বলে তৃতীয় বগিতে ঢুকে দেখতে দেখতে বগির একেবারে শেষে দরজার পাশে কয়েকটা বস্তা রাখা। সেই বস্তার ওপর বসে শরীর ছেড়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছে অনাবিল আনন্দ। কয়েক মুহূর্ত ঘুমন্ত অনাবিলের মুখের ওপর তাকিয়ে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে, মানুষটার এই শাস্তি পাওয়ার কথা নয়, আমার জন্য এসি রুম ছেড়ে বস্তার ওপর ঘুমুচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে, আনন্দের হাত ধরে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে। কিন্তু দ্বিধা আর সংকোচের কারণে পারে না। দরজা পার হয়ে দুই বগির মাঝখানে দাঁড়ায় মাত্রা। বেশ কয়েকজন যাত্রী দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
কতক্ষণ লাগবে চট্টগ্রাম পৌঁছুতে?
এইতো, আর পনেরো বিশ মিনিট, এসেই পড়েছি, পাশের যাত্রীর উত্তর।
এখন কী করবো? নিজের মনে নিজেই জ্বলে মাত্রা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে, রেজাল্ট এমনই হবে তোমার। কী এমন বলেছিল যে মানুষটাকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করলে? সবার পরিচিত প্রিয় অভিনয় শিল্পী হয়ে দেমাগ হয়েছে?
দরজা থেকে ফিরে এসে দাঁড়ায় ঘুমন্ত অনাবিলের সামনে। তাকায় দুই দিকে, লোকজন নিজেদের মতোই আছে, কিন্তু দু-একজন ওর দিতে তাকিয়ে আছে। কেন বাবারা, আমার দিকে তাকানোর কী আছে? নিজেই খেয়াল করে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে আবার বাম হাতে চেপে রেখেছে ওড়না, যেন মুখ প্রকাশ না পায়! মুখ ঢেকে রাখার কারণেই ওরা তাকাচ্ছে।
পরিস্থিতি দেখো, মুখ ঢাকলেও সমস্যা, না ঢাকলেও। আন্তঃনগর ট্রেন ‘সোনার বাংলা’ খটাং খটাং শব্দ তুলে ছুটছে চট্টগ্রামের দিকে। হয়তো আর দশ বা পনেরো মিনিটের মধ্যে স্টেশনে পৌঁছুবে। আমি কী করবো? এখানে দাঁড়িয়ে সঙ সাজবো না কি? আবার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণণ হারাতে হারাতে সিদ্ধান্ত নেয় মাত্রা, আমি রুমে যাবো। ট্রেন থামলে ভদ্রলোক তো ব্যাগ নেওয়ার জন্য হলেও রুমে আসবে।
যাত্রীদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখে বুঝতে পারে, ট্রেন চট্টগ্রাম স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। দ্রুত ফিরে আসে তিনটা বগি পার হয়ে, যাত্রীদের ঠেলাগুতো খেয়ে খেয়ে নিজের বাথে। রুমে ঢুকে কী করবে, বুঝতে পারছে না মাত্রা, একটা ফোন করবে লুসাইকে? যদি অনাবিল আনন্দকে চায়, ধুশ্-শালা কী যন্ত্রণার মধ্যে পড়লাম?
মাইক্রোফোনে ট্রেন চালকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, সুধী যাত্রী মহোদয়গণ, আর কিছুক্ষণের মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেন ‘সোনার বাংলা’ চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছুবে। আপনাদের মালামাল দেখে নিন। তাড়াহুড়ো করবেন না। অপরিচিতজনের দেয়া খাবার খাবেন না। বাংলাদেশ রেলওয়েতে ভ্রমণের জন্য ধন্যবাদ। খোদা হাফেজ।
খোদা হাফেজ তো বললি ব্যাটা, আমার কী হবে? নিজের মনে গজরায় মাত্রা। লোকটা কী কানে শোনে না, ট্রেনের ঘোষণা শুনে তো ঘুম ভাঙা উচিত। রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে সামনে রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে খায়, পানি খেয়ে গ্লাসটা কেবল টেবিলের ওপর রাখে, দরজা ঠেলে ঢোকে অনাবিল আনন্দ।
যাক বাবা, লোকটা হুঁশে আছে! বুকের ওপর থেকে দুশ্চিন্তার পাথর নামে মাত্রার।
সামনের সোফায় বসে আনন্দ, ট্রেন থামবে এখনই, বলার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের গতি কমে আসে, আমরা একটু পরেই বের হই, তাহলে যাত্রীদের হুড়োহুড়ির মধ্যে পড়তে হবে না। ঠিক মাত্রাকে উদ্দেশ করে নয়, তৃতীয় কাউকে লক্ষ করে বলছে।
মাত্রা তাকায়, অনাবিল খুব স্বাভাবিকভাবেই বলছে, কোনো রাগ বা অভিমান নেই গলায়। ভালো লাগে ভীষণ মাত্রার, মানুষটা সত্যিই অন্যরকম। বোকাচোদা পুরুষদের মতো গাল ফুলিয়ে থাকে না। পুরুষ মানুষ হবে এমন, যখন যেমন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবে।
ট্রেন থেমে গেছে। যাত্রীরা নামছে হুড়োহুড়ি করে। হাতে নিজের ব্যাগটা নিয়ে দাঁড়ায় অনাবিল, আমাদের বের হওয়া দরকার এখন।
চলুন, নিজেও ব্যাগ হাতে দাঁড়ায় মাত্রা।
শত শত যাত্রীর সঙ্গে চট্টগ্রামের ট্রেন স্টেশনে নামে দুজনে। মুখের ওপর পাতলা ওড়না পেচানো মাত্রার। সামনে হাঁটছে আনন্দ, পেছনে মাত্রা। অনেকটা পথ হেঁটে গেটে পৌঁছায় দুজনে। টিকিট চেকারের কাছে টিকিট দিয়ে বাইরে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হালকা পাতলা গড়নের একটা ছেলে জড়িয়ে ধরে আনন্দকে, ভাইয়া কেমন আছেন?
এই তো আছি, তুই কেমন আছিস বাবর?
অনাবিলের হাত থেকে ব্যাগটা প্রায় ছিনিয়ে নেয়, আমি থাকতে আপনি ব্যাগ টানবেন কেন?
ছোট ব্যাগ তো!
বুঝছি, চলেন।
তিন জনে স্টেশনের বাইরে খোলা জায়গায় আসে, একটু দূরে একটা মাইক্রোবাস অপেক্ষা করছে। মাইক্রোবাসের কাছে যাওয়ার পর আনন্দ বলে, বাবর ইনি হচ্ছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট অভিনয় শিল্পী মাত্রা মধুরিমা। মধুরিমা, ও ইলিয়াস বাবর, একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। সেটা আমার কাছে বড় পরিচয় নয়, বড় পরিচয় ইলিয়াস বাবর চমৎকার গল্প লেখে।
মাত্রা মুখের ওপরের ওড়না সরায়, ভালো আছেন?
ইলিয়্সা হাসে, জি ভালো। এতদিন আপনাকে দেখেছি টিভি নাটকে, আজকে সরাসরি দেখলাম। খুব ভালো লাগছে।
ওই ব্যাটা গাড়ি ছাড়তে বল, ধমকে ওঠে আনন্দ। পেটে ভয়ানক খিদে, এখান থেকে পটিয়া যেতে কতক্ষণ লাগবে?
ড্রাইভার নেমে দরজা খুলে দেয়। ইলিয়াস বসে ড্রাইভারের পাশে। মধুরিমা আর আনন্দ অনাবিল উঠে বসে পেছনের সিটে, পাশাপাশি। ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ে, স্টেশনের সামনের খোলা প্রান্তর পার হয়ে গাড়ি ছুটছে পটিয়ার দিকে, যেখানে জন্মেছিলেন বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির এক মহাপুরুষ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ।
অচেনা শহর চট্টগ্রাম মাত্রার, কখনো আসেনি আগে। ঢাকা শহরের তুলনায় যানজট একটু কম। গাড়ি দ্রুতই ছুটছে। পাশে যদিও মাত্রা কিন্ত তাকিয়ে আছে বাইরে। ইলিয়াস বাবর সামনে থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, ভাইয়া?
বল।
আমি আর লিখবো না।
মানে?
লিখে কী হবে? আপনার সঙ্গে তো পারবো না।
হাসে আনন্দ, তোর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।
এই সংখ্যার ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় আপনার লেখা গল্প ‘মানুষ বনাম রাক্ষসরাস্তা’ পড়ার পর মনে হয়েছে, এমন গল্প লিখতে না পারলে, ম্যাড়ম্যাড়ে গল্প লিখলে পাঠকের কাছে পৌঁছানো যায় না। শুধু শুধু পণ্ডশ্রম। আমি বুঝতে পারছি না, গল্পের ওই ধরনের প্লট আপনার মাথায় ক্যামনে আসে?
পাগল ছেলে, তাকায় মাত্রার দিকে, মাত্রা তাকিয়ে ছিল, চোখে চোখ পড়ায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় লাজুক হেসে, শোন, গল্প লেখা ছাড়া যাবে না। মাত্র তো শুরু করেছিস, জীবন যত সামনের দিকে যাবে, তত অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হবি। সঙ্গে প্রচুর পড়বি; দেখবি গল্পের প্লট মগজের মধ্যে ভিড় করে মিছিল করছে। আমাদের জীবনের চারপাশে কত গল্প ছড়িয়ে আছে জবাফুলের মতো, বেত ফলের মতো, কাঁঠালিচাপার মতো, ব্যর্থ প্রেমের মতো, স্বার্থক ফোটা ফুলের মতো, কেবল কুড়িয়ে নিবি দুহাত ভরে।
আপনার মতো করে কেউ তো বলে না, আকুতি বাবরের গলায়।
আমরা খুব সীমাবদ্ধ আর আত্মপীড়িত জাতি। আমরা নিজেরা স্বপ্ন দেখি না, ফলে অন্যকেও দেখাতে পারি না। কিন্তু সীমাবদ্ধতার দেয়াল তো ভাঙতে হবে, না কি!
জি ভাঙতে হবে, আপনার নেত্বেতেই ভাঙবো আমরা; আশাবাদী কণ্ঠ ইলিয়াস বাবরের।
হাসে অনাবিল আনন্দ, আমার নেতৃত্বে? আমি এক চুনোপুটি, কত রাঘববোয়াল ঢাকা শহরের মাটিতে লাটিম খেলে, সেখানে আমি কে?
আপনার মতো কেউ আশা-ভরসা দেয় না।
সময় আসুক দেবে, কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে।
এগিয়ে এলেই ভালো। বাবর তাকায় মাত্রা মধুরিমার দিকে, আপনার ওই নাটকটা—যেখানে আপনি সিনেমার এক্সটার ভূমিকায় ছিলেন—নামটা মনে করতে পারছি না।
নাটকের নাম ‘আড়ালের কুসুম’ মনে করিয়ে দেয় অনাবিল আনন্দ।
রাইট! ইলিয়াস বাবর উৎফুল্ল গলায় বলে, এই নাটকটা না দেখলে জানতামই না, সিনেমার এক্সটা মেয়েদের নিয়ে এমন স্থূল নোংরামি হয়। ভাইয়া, নাটকটা আপনি লিখেছিলেন?
না, আমি লিখিনি। ‘আড়ালের কুসুম’ নাটক লিখেছে অমল সাহা। ও আমার বন্ধু।
সত্যি আপা, আপনি দারুণ অভিনয় করেছেন।
অনাবিল আনন্দ ডান হাতটা রাখা দুই জনের মাঝে সিটের ওপর। অনুভব করছে, হাতটার ওপর একটা হাত এসেছে। তাকায়, হাতটা মাত্রার, কিন্তু তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, নাটক দেখেছেন, মনে রেখেছেন, প্রশংসা করছেন—মাত্রা মধুরিমা হাসে। আজকাল পথেঘটে নানা জায়গায় কত মানুষ, কত ভক্তের সঙ্গে দেখা হয়, ছবি তুলি, সবাই প্রশংসা করে কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো নাটকের নাম বলতে পারে না। না পারারও কারণ আছে, প্রচুর নাটক হয়, নাটকের আড়ালে ফাটক হয়, স্রোতে হারিয়ে যায় সবকিছু।
বাবর?
বলুন ভাইয়া, পেছনে ফেরায় মুখ।
তুই মাত্রার ‘ডালিমফুলের মৌ’ নাটকটা দেখেছিস?
নাহ!
গ্রামীণ পটভূমিতে অসাধারণ নাটক ‘ডালিমফুলের মৌ’। একজন কৃষকের স্ত্রীর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছে। গ্রামীণ মহাজনের লালসায় স্বামী জেলে যায়। দুটি সন্তান আর কয়েকটি গরু নিয়ে যে লড়াইটা করে কৃষকের জোয়ান বউ, অনন্য লড়াই করেছে অভিনয়ের মাধ্যমে মাত্রা। বিশেষ করে নাকে নথ পরে যখন গ্রামীণ ঘাসের রাস্তায় বা মাঠে হাঁটতো গরুর সঙ্গে, পেছনে দুটি বাচ্চা, অনবদ্য লেগেছে ওকে—তাকায় আনন্দ।
ওর দিকে তাকিয়ে আছে মাত্রা।
হাসতে হাসতে বলে অনাবিল আনন্দ, সত্যি বলছি মাত্রা আপনার সেই অভিনয় ভুলবার নয়।
সেই নাটকটা আমারও খুব প্রিয়। যখন অভিনয় করেছিলাম, বছর আটেক আগে, তখন খুব ঝড় যাচ্ছিল আমার ওপর দিয়ে। একবার ভেবেছিলাম নাটকটা ছেড়ে দেই কিন্তু পরিচালক মমতাজ খসরু আমাকে ছাড়লো না। বললো, সখিনার এই ক্যারেক্টারে আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই ভাবতে পারছি না। তার তাগিদেই নাটকটা করলাম। না করলে খুব ভুল করতাম।
এটা কর্ণফুলী নদী না? গাড়ি ব্রিজের ওপর উঠেছে?
জি ভাইয়া, জবাব দেয় বাবর।
ড্রাইভার ভাই, গাড়িটা মাঝ বরাবর রাখবেন, আমরা ছবি তুলবো, বলে অনাবিল আনন্দ।
ঠিক আছে স্যার।
গাড়ি ব্রিজের মাঝ বরাবর থামলে নামে তিনজনে। মাঝখানে মাত্রাকে রেখে সেলফি তোলে অনাবিল। যখন সেলফি তোলে, মাত্রা খুব কাছে চলে আসে, শরীরের সঙ্গে শরীর লেগে যায়। অনাবিল আনন্দ পাশ থেকে যতোটুকু সম্ভব, দূরে থাকার চেষ্টা করে শরীর বাঁকা করে। অনাবিলের সরে যাওয়া বুঝতে পেরে মাত্রার মধ্যে এক ধরনের ছেলেমানুষী জাগে, মানুষটা যতই সহজ-সরল হোক না কেন, ভেতরে ভেতরে রেগে আছে। কিন্তু রোদের তীব্র দাপটে সেলফি ভালো হয় না। ড্রাইভারকে ডাকা হলে মাত্রা, আনন্দ আর বাবর মিলে ছবি তোলার সময়ে হঠাৎই আনন্দ মাঝখান থেকে সরে যায়, বাবরকে মাঝে দিয়ে নিজে তৃতীয় স্থানে, বাবরের পাশে দাঁড়ায়। মাত্রার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি খেলে যায়, এটা কোনো ছবি হলো?
কেন ছবি হবে না? বাবর অবাক।
আরে বাবা আমরা তিন জন না? আমি একমাত্র নারী—আমাকে মাঝখানে রেখে দুই পুরুষ দুই পাশে দাঁড়ালে না একটা চমৎকার ছবি হবে। ফেসবুকে পোস্ট দিলেও বন্ধুরা দেখে মজা পাবে।
বাবর সমর্থন করে, রাইট। ভাইয়া, আপু ঠিক বলেছেন। আসুন, আপুকে মাঝখানে রেখে আমরা একটা ছবি তুলি। বাবর মোবাইলটা আবার ড্রাইভারকে দেয়।
বিরক্তি অনাবিলের গলায়, বাবর অনেক ছবি তুলেছি। আর দরকার নেই—গাড়ির দিকে যায় অনাবিল।
ভাইয়া, অন্তত একটা ছবি তুলুন—দৌড়ে এসে হাত ধরে, একটা ছবি তো। আর দেখুন, আপু রৌদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে আপনার জন্য।
মাত্রা চোখের সামনে ডান দিয়ে রোদের আঁচ থেকে মুখ রক্ষা করার চেষ্টা করছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে মাত্রার পাশে এসে দাঁড়ায় আনন্দ। ওপাশে ইলিয়াস বাবর। মাত্রা ইচ্ছে করেই শরীরঘেঁষে দাঁড়ায় অনাবিলের দিকে। সরে যেতে চায় অনাবিল কিন্তু পারে না বাবরের জন্য। ভেতরে ভেতরে হাসে মধুরিমা। ঝটপট ছবি তোলে ড্রাইভার। কয়েকটা ছবি তোলার পর ইলিয়াস দৌড়ে ব্রিজ পার হয়ে ড্রাইভারের হাত থেকে মোবাইলফোন নেয়, ভাইয়া আপুর পাশে দাঁড়ান। ফটাফট কয়েকটা ছবি তোলে বাবর।
ছবি তোলার পর গাড়িতে উঠলে গাড়ি ছাড়ে ড্রাইভার। ফোন বাজে বাবরের, ভাইয়া শহীদুল ভাইয়ের ফোন।
ধর।
হ্যালো ভাই, আনন্দ ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলুন।
ফোনটা হাতে নেয় অনাবিল, শহীদুল আমরা কর্ণফুলী নদী পার হচ্ছি। কতক্ষণ লাগবে তোমার বাড়ির সামনে পৌঁছাতে?
আধাঘণ্টা লাগবে।
ওকে, আসছি। আর ভীষণ খিদে পেয়েছে।
আমি টেবিলে খাবার দিতে বলছি, আপনারা আসুন।
ওকে।
মোবাইল ফিরিয়ে দেয় বাবরের হাতে, এই কর্ণফুলী নদীকে কেন্দ্র করে একটা উপন্যাস আছে জানিস তো?
নাতো, বাবর ফিরে তাকায়।
সত্যি জানিস না? একটু অবাক অনাবিল আনন্দ।
সত্যি জানি না।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশিষ্ট কথাশিল্পী আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘কর্ণফুলী’ নামে একটা উপন্যাস লিখেছেন। তিনি, সম্ভবত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে চট্টগ্রামে কয়েক বছর কোনো কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। সেই সময়ে তিনি উপন্যাসটি লিখেছেন—দারুণ উপন্যাস।
পড়বো আমি, আমার লজ্জা লাগছে আমি চট্টগ্রামের ছেলে অথচ জানি না—ইলিয়াস বাবরের গলায় হতাশা।
অনাবিল আনন্দ ডান হাতটা রাখা দুই জনের মাঝে সিটের ওপর। অনুভব করছে, হাতটার ওপর একটা হাত এসেছে। তাকায়, হাতটা মাত্রার, কিন্তু তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। নিজের হাতটাকে নিয়ে কী করবে, বুঝতে পারছে না অনাবিল আনন্দ। কিন্তু ভীষণ ভালো লাগছে মাত্রার এই স্পর্শ অভিনয়। অথচ বিষাক্ত আগুনে পুড়ে যাওয়ার কথা হাতটা।
চলবে…