দ্বিতীয় পর্বের পর:
ওই শহরের আরও দু’জন মানুষ কবিতাবান্ধব সব কর্মকাণ্ডকে অকুণ্ঠ সমর্থন যোগাতেন। তারা হলেন অধ্যাপক জুলফিকর রফিক রনজু ও প্রাবন্ধিক আহমদ সাইফ। বিশেষ করে অধ্যাপক রনজু, অত্যন্ত সরল জীবনাদর্শ লালন করা সাদামনের মানুষ। আজীবন পাঠমগ্ন থেকেছেন। বইয়ের জগতেই যাবতীয় বোঝাপড়া। মসজিদমুখী হননি কখনও। পাড়ার লোকেরা হুমকি-ধমকিও দিয়ে রেখেছে। মৃত্যুর পরে মহল্লাবাসী জানাজায় অংশ নেবে না। আহমদ সাইফ ২০০৭-এ মৃত্যুবরণ করেছেন। জীবনের ওপারে আর কোনো জগত থাকলে সে জনমেও তিনি যেন প্রাবন্ধিকের জীবন কাটান, তাঁর জন্য এই থাক কামনা।
অধ্যাপক জুলফিকর রফিক রনজু এখন ষাটোর্ধ্ব। শিল্প-সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল সব কর্মকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা বরাবরই অগ্রগামীর। শহরের প্রগতি, অর্ধ-প্রগতিবাদীরা ‘সময়ে’ তার সবটুকু ব্যবহার করেছেন। এখন তিনি রোগ-শোকে অনেকটা ম্লান ও নিঃসঙ্গ।
সহজ সুন্দর ও সরলতার একটি ছোট গল্প; অধ্যাপক রনজু ছোট-বড় সবাইকে ‘আপনি’ সম্বোধনে কথা বলেন। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গেও। একদিন হঠাৎ বেশ জোর দিয়ে বাসায় যেতে বললেন। শুক্রবার সন্ধ্যা, ছুটির দিন। শীতকাল ছুঁই-ছুঁই করছে। বাসায় পৌঁছে বিস্মিত হতে হলো। সারাটা বাড়িজুড়ে অসংখ্য বই আর বই। ঘরের দেয়াল পর্যন্ত দেখা যায় না। বিছানাপত্র সর্বত্রই বইয়ের রাজ্য। তিনি পাণ্ডুলিপি হাতে বসলেন, পাঠ করে শোনাতে লাগলেন তাঁর প্রবন্ধ। হঠাৎ জানতে চাইলেন, আপনি সিগারেট খান? হতবাক হয়ে বললাম, না খাই না! বললেন, আমার মনে হয় আপনি মাঝে-মাঝে খান। গোল্ডলিফের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, শোনেন আমি আপনার কবিতা পড়েছি। হতে পারে আমি শিক্ষকতা করি কিন্তু কবিতার জায়গাটিতে আমরা উভয়ে সমান। এখানে কোনো ছোট-বড়, ছাত্র-অধ্যাপক ভেদাভেদ নেই। আপনি ক্রিয়েটিভ মানুষ। সিগারেট ধরান, বলে নিজেই ম্যাচের কাঠি জ্বেলে মুখের কাছে ধরলেন। আবার শুরু হলো পাঠ। পাঠের মাঝে কিছুটা থামলেন। এবার জানতে চাইলেন, আপনি প্রেম করেন? করেন বা না-করেন আপনি কবি। কবিরা প্রেমকে পর্যবেক্ষণ করবে, ধারণ করবে কিন্তু প্রেমে পড়বে না। পড়বে না অর্থ ‘পতন’ হয়ে যাবেন না। সুফিবাদে যাকে বলে ফানাফিল্লাহ। অর্থাৎ ফানাফিল্লাহ হয়ে যাবেন না। আর বুকের মধ্যে যে ব্যথার নির্যাসটুকু জমা হবে, তাকে যত্ন করে আগলে রাখবেন। সে একদিন ফুলে-ফলে ভরে উঠবে। কবিতার জন্যে ওইসব ফুল-ফল খুব জরুরি।
রাতের খাওয়া শেষ হলো। সাহিত্য রাজনীতি অর্থনীতিসহ নানান কথার ফুলঝুরি শুনতে শুনতে শেষ হলো সেদিনের আড্ডা। মধ্যরাতে এগিয়ে দিতে এলেন বড় রাস্তার মোড়ে। বিদায়ী হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আগামী সপ্তাহে আবার আসেন, কী খাবেন বলবেন। আপনার ভাবী সেভাবে রান্না করে রাখবে।
চারদিকে শিশির ভেজা জোছনা গলে গলে পড়ছে। পাশের ঝোপঝাড়ে অল্প কিছু জোনাকি পোকার আনাগোনাও দেখা গেলো। প্রথম জীবনের ভালোবাসার মানুষটির খোঁজ জানেন না বহুদিন। কবিতার বইটি তাঁর নামে করা যায় কি না—তা নিয়ে ভাবছেন। খাবার হোটেলগুলো থেকে ভেসে আসছে মুজিব পরদেশীর ব্যথাভরা গান ‘মরণকালে যেন বন্ধু একবার দেখা পাই’’। দুই সময়ের দু’জন মানুষ একই ‘সমান্তরালে’ দাঁড়িয়ে আছে। সমান্তরালটির নাম কবিতা না কোমল জোছনা? একজন হাত দিয়ে চোখের পানি সরানোর চেষ্টা করছেন। অন্যজন…
সব বাধা পেরিয়ে ‘শালিকজংশন’ চার রঙা প্রচ্ছদে মুদ্রিত হলো। কৃতজ্ঞতায় বেশ কয়েকজনের নাম শোভা পেলো। নেপথ্যে যে মানুষটির ভূমিকা সর্বাত্মক, তাঁর নাম নেই কোথাও! ভেতরেও থাকলো বেশ কিছু অলংকরণ। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রচ্ছদ ছাপা হওয়া ছাড়া তেমন কোনও আলোচনা হলো না। কবি সিদ্ধার্থ শংকর ধর পরিচিতিমূলক একটি আলোচনা লিখেছিলেন ‘লোক’-এ।
তবে কবি বন্ধু এহসান হাবীব দীর্ঘ আক্রমনাত্মক ক্রিটিকস লিখলেন ব্লগে। বিশেষ করে আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে সে আক্রমণের শুরু। বাম ও আওয়ামী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সম্পাদক কী করে জাতীয়তাবাদী বিএনপির একজন সংসদ সদস্যের সহযোগিতা নিতে পারে! তিনি আমার অবস্থানকে সর্বাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ করে তুললেন। সেসব আক্রমণের অবশ্য সহজ কিছু উত্তর ছিল। পাল্টা আক্রমণ করে লেখারও আহ্বান ছিল বন্ধুদের তরফ থেকে। কিন্তু উত্তরগুলো খোঁজার দায়িত্ব মনে মনে এহসানের কাছেই রেখে দিলাম।
জানি না সেই উত্তরগুলো পরবর্তী সময়ে এহসান খুঁজে পেয়েছিলেন কি না। এ নিয়ে তাঁর মুখোমুখি আর হইনি কখনো। পরবর্তী সময়ে এহসান হাবীবের সম্পাদনায় ‘শূন্য’’ প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক রীতিনীতির কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না জানি না। তবে ওই সময়, ২০০৩-এর দিকে যারা সরকারি বিজ্ঞাপনের দ্বারস্থ হতেন, তারা সবাই জানেন একটি একশ’টাকার বিজ্ঞাপন চাইতেও তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের অনুমোদনের প্রয়োজন হতো। টাকাটা প্রজাতন্ত্রের, সেটার প্রতি আপনার বা আমার যৌক্তিক অধিকার আছে। এহসান যদি শূন্যে’র জন্যে কোনো সরকারি বিজ্ঞাপনের আবেদন করে থাকেন, তবে নিশ্চয় তাঁকেও সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
‘শালিকজংশন’—তারুণ্যের আবেগ, ক্ষোভ-অভিমানের বিচিত্র পরিবর্তশীল এক পরিক্রমা মাত্র । হতে পারে সে অপরিণত বয়সের কাব্যভাবনার অগোছালো প্রকাশ। (এ অনুধ্যান কেবল ‘মায়া ও স্কিৎসোফ্রেনিয়ার কাব্য’ প্রসঙ্গে) কবিতার বিচারে নয়, তারুণ্যের সেই উচ্ছ্বাসটুকুকে খাটো করে দেখা যায় না কোনোভাবেই। আর আসবেও না ফিরে দুরন্ত সেই হরিণসন্ধ্যার দিনগুলো। স্কুলের সহপাঠীরা কেউ একজন অংক বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় আল্পনার মতো এঁকে নিচে লিখে রেখেছিল, ‘তোমার বইয়ের শেষের পাতায় এঁকে দিলাম আল্পনা, আমার স্মৃতি কইবে কথা যখন আমি থাকব না’। স্কুলের আর কোনো পাঠ মনে নেই। কিন্তু অজানা সেই আল্পনা শিল্পীর লেখা কথাগুলো মনে পড়ে খুব। আজান্তেই ভিজে ওঠে চোখ।
অম্ল-মধুর স্বর্ণখচিত সে দিনগুলো ধরা থাক স্মৃতির পৃষ্ঠায়। আবার কোনো দিন পৃষ্ঠা উল্টে দেখে নেব। একদিন আমিও বসেছিলাম সম্পাদনার টেবিলে। পুনশ্চ বলি: ‘কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।’ শালিক নয়, শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা দিয়ে শেষ হোক।
অচেনা মানুষ
বলো আমাকে, রহস্যময় মানুষ
কাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো;
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, অথবা ভগ্নীকে?
পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী কিছুই নেই আমার।
তোমার বন্ধুরা?
ওই শব্দের অর্থ আমি কখনো শিখিনি।
তোমার দেশ?
জানি না কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান।
সৌন্দর্য? প্রেম?
পারতাম বটে তাকে ভালোবাসতে
দেবী তিনি, অমরা।
কাঞ্চন?
ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন
তোমরা ঘৃণা করো ঈশ্বরকে।
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ,
কি ভালোবাসো তুমি?
আমি ভালোবাসি মেঘ…চলিষ্ণু মেঘ…
ওই উঁচুতে ওই উঁচুতে….
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
(ভাষান্তর: বুদ্ধদেব বসু)
শেষ