তুমি আমায় ডেকেছ
১.
সজল রুহিকে ভালোবাসতে চায়।
যদিও সজল তখনো নিশ্চিত নয় এ ভালোবাসা অথবা ভালোবাসতে চাওয়া তাৎক্ষণিক, না অনেক দিনের জন্য। সজলের এই ‘ভালোবাসতে চাওয়া’ রুহির প্রতি প্রথম কিম্বা একমাত্র নয়। কিন্তু আমরা বুঝে যাই রুহির প্রতি জন্মানো এ অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী। মানে সে রুহিকে ভালোবেসে ফেলেছে।
সজল রুহিকে প্রপোজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সজল যখন ভালোবাসতে চাওয়া না চাওয়ার দোলাচলে, রুহি তখন পরিসংখ্যান ক্লাশে ঝিমুচ্ছিল। পূর্ববর্তী রাতে সে ঘুমায়নি। সারা রাত রুহি পরিসংখ্যানের একটি অংকই মেলানোর চেষ্টা করছিলো।
প্রণয় প্রস্তাব নিয়ে কম কালি খরচ হয়নি এ গ্রহে; সুতরাং ওদের দু’জনের প্রেম কিভাবে সংগঠিত হলো সে বর্ণনায় না গিয়ে ভাবতে থাকি যে—ওরা এখন প্রেমিক-প্রেমিকা। সম্প্রতি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্তে উভয় পরিবারের অসম্মতি হেতু গোপনে বিয়ে করে ফেলে। সেই সাথে আমাদের যেন মনে থাকে সজল স্নাতক ফলপ্রার্থী ও রুহি চতুর্থ বর্ষের ফাইনালের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
সজল আগে থেকেই একটা বায়িং হাউসে চাকরির ব্যবস্থা করে রেখেছিল; ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া করে দু’জনে মিলে সুখে শান্তি বাস করতে লাগল।
গল্পটি এখানে শেষ করা গেলে ভালো হ’তো, কিন্তু তাতে গল্পটি আর গল্প থাকতো না। তাই আমরা আরেকটু ভাবতে থাকি।
যেহেতু বিয়ের কারণে রুহি অনার্স শেষ পর্বের পরীক্ষা দিতে পারেনি, যেহেতু সজল বায়িং হাউসে এন্ট্রি লেবেলে চাকরি করে, তাই আপাতত রুহির পক্ষে পড়াশোনা আর চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না।
আমরা এখন তাদের সংসারের দিকে মনোনিবেশ করতে পারি। সজল খুব ভোরে অফিসে চলে যায়, ফেরে বেশ রাতে। ফলে রুহির সাথে কর্মক্লান্ত সজলের খুব একটা কথাবার্তা হয় না; যেটাকে অন্তত সাংসারিক খুনসুটি বলা যেতে পারে। বলা চলে রুহিকে সময় দেওয়ার মতো সময় সঙ্গত কারণে আর সজলের নাই। ফলে রুহি বন্দি হয়ে পড়ে দীর্ঘ একাকীত্ব ও আলস্যের গহ্বরে। প্রথম প্রথম এটা কোন সমস্যা তৈরি না করলেও এক সময় রুহি ভেতরে ভেতের হাঁপিয়ে ওঠে। দু’জনের ইচ্ছা সত্ত্বেও কেন রুহি কন্সিভ করছে না সে বিষয়ে না ভেবে যদি ওদের বেডরুমের জানালা দিয়ে গলির দিকে তাকাই, তাহলে আমরাও একটি নির্জন রাস্তা দেখতে পাবো।
ঢাকা শহরে এরকম একটা আলোকিত কিন্তু নির্জন গলি থাকতে পারে রুহির জানা ছিল না। রাস্তাটি দুইটা ৯০ ডিগ্রি স্পষ্ট মোড় নিয়ে খানিকটা আঁকা বাঁকা হয়ে ডিআইটি রোডে মিশেছে। রুহিদের বাসার সমানে দিয়ে গলির রাস্তাটা অবশ্য সোজাসুজি। বৈদ্যুতিক পিলারের সাথে লাগানো সবগুলো বাতি ঠিকঠাক জ্বলছে। অবশ্য স্বস্তির কথা এই, মাঝখানের একটি পিলারের আলো নেই, বাতি নষ্ট। সেখানটায় অন্ধকার; বেশ অন্ধকার। কাব্যিক ভাষায় বললে, একখ- অন্ধকার জমে আছে যেন রাস্তার ধারে। চোখের ভ্রম কিনা, সেই অন্ধকারে দু’একটি জোনাক পোকার টিপটিপ আলোও আছে!
শুনেছি নৈঃসঙ্গ বিধুর; নৈঃসঙ্গময় অপেক্ষা মধুর। তবে পুনঃপৌণিক ভাবে ঘটতে থাকলে তা মাধুর্য হারিয়ে ফেলে। এইসব ভাবতে ভাবতে আমরা লক্ষ্য করবো রুহি এখন ফোনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করে। সেটা যে সজল নয় তা অনুমান করা কঠিন নয়; কিন্তু রুহি-সজলের কয়েকদিন আগের কনভার্সেশন থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব যে তারা পরস্পরকে নিয়ে সুখী। তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে কিম্বা অপ্রকাশ্যে কোন দূরত্ব তৈরি হয়নি। অথচ রুহি কখনো আধশোয়া হয়ে, কখনো পা নাড়িয়ে, কখনো চেয়ারে হেলান দিয়ে, কখনো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সকাল সন্ধ্যা ফোনে কার সাথে যেন কথা বলে। সজলকে নিয়ে তার ভেতর কোনো অপ্রাপ্তি নাই। বরং সজলের জন্য তার বেশ মায়া হয়—বেচারা দিন নাই রাত নাই গাধার মতো খাটছে। কার জন্য, সেতো রুহির জন্যই। শত তদন্ত করলেও রুহির কললিস্টে সন্দেহজনক কোন নাম্বার পাওয়া যাবে না। ইনফ্যাক্ট সজলের নাম্বার ছাড়া অন্য কোনো নাম্বারও পাওয়া যাবে না। আবার ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলার মতো সময় সজলের নেই।
এরমধ্যে এক বিকেলে আমরা আবিষ্কার করবো রুহি বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। কিন্তু এই বাইরে যাওয়া অন্যান্য দিনের মতো নয়; মানে বাজার সদাই বা প্রয়োজনীয় টুকিটাকির জন্য যেরকম সে বাইরে যেতো। রুহি আজ কিছুটা নার্ভাস। আবার ভেতরে ভেতরে উৎফুল্লও। ফোনের অপরপ্রান্তের সাথে কথা বলার পর থেকে রুহির দিনগুলো ভালোই কাটছে। বিরামহীন অবসর ও একাকীত্বের যন্ত্রণা নেই। সাজসজ্জা শেষ হতে হতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। রুহির চোখ মুখে আনন্দের শিশির।
সন্ধ্যা পেরিয়েছে অনেকক্ষণ। ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে শুরু করেছে। গলির নির্জন রাস্তাটি একবুক আলো নিয়ে পড়ে আছে। সেই আলোর মধ্যে একখণ্ড অন্ধকার কয়েকটা জোনাক পোকা নিয়ে পড়ে আছে। এ অন্ধকারও গভীর হচ্ছে, ধীর ধীরে আরো স্পষ্ট হচ্ছে জোনাক পোকা।
রুহি বেরিয়ে পড়েছে। সে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। গলির অন্ধকার খণ্ডটির কাছাকাছি আসতেই আমরাও দেখতে পাই দুই চোখ বিস্ময় নিয়ে সজল দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে সে স্থির তাকিয়ে আছে রুহির দিকে। রুহিও দেখতে পেয়েছে সজলকে।
২.
রুহির সামনে সজল ও অন্ধকারটি, যার ভেতর জ্বলছে নিভছে জোনাক আলো; ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা নেমে আসে গলির মধ্যে। রুহির মনে হতে থাকে চরাচরে আর কিছু নেই, কোথাও আর কেউ নেই; সে দেখে আলোর হাতছানি দিয়ে অন্ধকার তাকে ডাকছে; প্রথম প্রেমের বেদনার মতো ভরে ওঠে তার মন। সে সেদিকে পা বাড়ায়।
জীবনের এই সাধ, সুপক্ক যবের ঘ্রাণ
অবশেষে তিনি মারা গেলেন।
তিন জন পাওনাদার মিলে তাঁর কাছে মাত্র ৬০ হাজার পেতো; এক বন্ধু পেতো একটি অসমাপ্ত চিঠি। বন্ধুপত্নী পেতেন একটি জমজমাট রাতের আশ্বাস; সাবেক একজন প্রেমিকা তার বিয়ের দিন, যদি নিমন্ত্রণটি রক্ষা করতেন, তবে একটি উপহার পেতে পারতেন। অথচ এইসব বকেয়া রেখে মরে গেলেন।
তিনি যে মারা যাবেন এটা মোটামুটি আমি জানতাম। গত কয়েক বছর ধরেই একটি মহত্তম রোগে ভুগছিলেন। তার বুকে ছিলো গভীর গোপন বাষ্প। এই বাষ্প বুকে ধারণ করে দিনে দিনে অগ্রসর হচ্ছিলেন একটি কাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর দিকে। প্রায়ই আমাকে বলতেন, দ্যাখ, মানুষের জন্মে তার নিজের হাত নেই। কিন্তু চাইলেতো মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু করতে পারে।
তাঁর প্রেমিকার নাম ছিল গহন। প্রায়ই গহনের কাছে চুম্বন প্রার্থনা করেতেন। প্রেমিক তার প্রেমিকার কাছে চুম্বন প্রার্থনা করবে এটা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। কিন্তু গহন কোন মানবী ছিল না। মুলত তখন থেকেই মহত্তম রোগটি তাঁর মধ্যে সংক্রমিত হতে শুরু করে। তিনি যে রোগটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না এমন নয়; রোগটিকে বরং সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।
তাঁকে প্রতি সন্ধ্যায় থরথর করে কাঁপতে দেখতাম। সন্ধ্যায় সড়কের পাশে পথচারীদের বিবিধ দৃষ্টির সামনে একা একা কাঁপতেন। সকলেই ভাবতো নেশায় পড়ে লোকটা শেষ হয়ে গেল। তবে ঠিক কোন নেশাবস্তুটি গ্রহণ করতেন কেউ জানতো না। আমি জানতাম; নিজের সৃষ্টির নেশায় এ রকম কাঁপতে আমি আর কাউকে দেখিনি কোনো দিন।
পিতা তাঁকে বর্জন করেছিলো; অথচ গহনকে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু শেখেননি। বন্ধুপত্নীর মুগ্ধ আবদার রক্ষা করতে যেয়ে তিনজন পাওনাদর সৃষ্টি করেছেন অবলীলায়। এটা কেবল তিনিই পারতেন কারণ ততোদিনে তাঁর বুকের ভেতরের বিষণ্ন বাষ্পে এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে তিনি আরো বিশুদ্ধ ও নিখুঁত হয়ে উঠছিলেন। এর মধ্যে একদিন আমাকে জানালেন সহজতম মৃত্যু সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে; মৃত্যুর সময় যন্ত্রণাজনিত ব্যঘাত যেন না ঘটে।
আমি যখন মৃত্যু বিষয়ক কাজে ব্যস্ত, তিনি ফোন দিলেন একদিন; কি পেয়েছ কোন উপায়? আমি আমতা আমতা করতেই বললেন, খুঁজতে থাকো; তোমাকে যে কারণে ফোন দিয়েছি তা হ’ল, আমার ভেতরে যে বাষ্প ঘনিভূত হচ্ছিল, বিকশিত হচ্ছিল আশ্চর্য সৌন্দর্য, অবিলম্বে তার সমাপ্তি দরকার। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। এই ভয়াবহ সুন্দর থেকে আমি মুক্তি চাইছি। এবং আমার সময় হয়েছে ব্যধিকে সংহতি দেওয়ার।
তিনি বলতেন, মানুষ জন্মগ্রহণ করে না। মানুষের জন্ম হয়। ঘাস-লতাপাতা-গরু-ভেড়া-সিংহ-শুয়োরের মতো মানুষও জন্মায়। নিজের জন্মকে গ্রহণ করার সুযোগ মানুষের নেই। তবে মৃত্যুকে গ্রহণ করার সুযোগ আছে। আমি মৃত্যুকে গ্রহণ করবো। হ্যাঁ, মৃত্যুকে গ্রহণ করার ব্যপারে তিনি যথেষ্ট সিরিয়াস ছিলেন। আমরা প্রায়ই দেখতাম গভীর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে হাঁটছেন শহরের সবচেয়ে নির্জন রাস্তায়। তাঁর একটি বাইক ছিলো। সেই বাইকে চড়ে মাঝে মাঝেই চলে যেতেন মেঘের দেশে। গভীর দুপুরের বৃষ্টি থেকে ফোটা ফোটা দুঃখ তুলে নিতেন। আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখতাম তাঁর ভেতরের বাষ্প কিভাবে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছিল। এসব করতে করতে নেশাগ্রস্থের মতো দুলতে থাকতেন; তখন তাঁর কাঁধ স্পর্শ করতো একটি গোপন হাত। যে হাতের স্পর্শে স্থিরতা নামক আরোগ্য লাভ করতেন।
কিন্তু এইসব স্থিরতা, নৈঃশব্দ্য আর স্পর্শ উপেক্ষা করে বাষ্প আর বেদনার আহ্বানে সাদরে গ্রহণ করে নিলেন মৃত্যুকে। স্বপ্ন ও মৃত্যু যে এত নৈকট্যময়, তাঁর ঝুলে থাকা শরীরের দিকে তাকিয়ে সেই প্রথম টের পেলাম।
রায়ট
১.
আজ প্রায় নয় দিন। রমেশ মাস্টার সপরিবারে লুকিয়ে আছেন দিনু পালোয়ানের বাড়ি। অবশ্য এরমধ্যে অনেকেই জেনে গেছে তিনি এ বাড়িতে লুকিয়ে আছেন। কিন্তু দিনু পালোয়ানের ভয়ে কেউ এদিকে আসতে সাহস করছে না। দিন চারেক আগে বল্লম, কোঁচ ইত্যাদি হাতে বিশ-পঁচিশ জনের একটা দল এসেছিলো তার খোঁজে। দিনু পালোয়ান স্পষ্টই বলে দিয়েছ, ‘সাবধান এখানে কেউ আসবি না; এরা মোসলামান হইয়া গেছে’। মুসলমান হয়েছে শুনে সাবই ফেরত গেছে। কিন্তু স্ত্রী-কন্যা নিয়ে এভাবে লুকিয়ে থাকতে রমেশ মাস্টারের ভালো লাগছে না। আবার বেরুলেই মেরে ফেলবে। কয়দিন আগে হরিহরের তিন ছেলেকে জবাই করে মেরে ফেলেছে। আগুন দিয়েছে শীলদের বাড়িতে। শেষমেশ দিনুর সাথে যুক্তি করে ঠিক করলেন তিনি মুসলমান হয়েছেন এই সংবাদ জানিয়ে গ্রামবাসীদের একটা গরু জবাই করে খাইয়ে দিবেন। বুদ্ধিটা দিনুই তাকে দিয়েছে। দিনু বলেছে, ‘আপনে তো আর সত্য সত্য মোসলমান হইতেছেন না; এখন রাইটের টাইম। এই সময় বাঁচার জন্য মিথ্যা বলতে হইবো। সব ব্যাবস্থা আমিই করুম। আপনি শুধু একটা গরু কিনার টাকা দিবেন।’ শেষে গ্রামে একটা গরুভোজ দিয়ে রমেশ মাস্টার নিজ বাড়িতে উঠলেন। সবাই জানলো রমেশ মাস্টার মুসলামান হয়ে গেছে।
২.
হরি ডাক্তারের বিশ্বাস ছিলো এ গ্রামে তাকে কেউ মারবে না। তার হাতের অষুধ খায় নাই এরকম কেউ এ গ্রামে নাই। এ গ্রাম কেন আশপাশের দশ গ্রামেও নাই। এ দৃঢ় বিশ্বাসের কারণে অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি গ্রাম থেকে নড়েননি। হরিহরের তিন ছেলেকে সেদিন মেরে ফেলেছে এ সংবাদ তিনি পেয়েছেন মোতালিবের কাছ থেকে। সে-ই তাকে বলেছে, ‘কাকা, দেশের অবস্থা সুবিধার না। আপনে কলিকাতা চইলা যান।’ হরি ডাক্তার যায়নি। বলেছে, ‘কলিকাতা আমার কে আছে? নিজের ভিটা ছাইড়া কই যামু ক? আমার কিছু হইবো না; তোরা আছস না।’
৩.
নৌকায় জনা বিশেক যাত্রী। কানু চৌমুহনী এসেছিলো এক আত্মীয় বাড়িতে। ফেরার পথে লুঙ্গি পড়ে বের হয়েছে। নৌকার কেউ জানে না সে হিন্দু। সে যাবে আবির পাড়া। খালটা তাদের গ্রাম হয়ে অনেক ঘুরে আলাদীনগর নামক একটা গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে; অনেক বছর পর যে গ্রামে তাঁর এক উত্তর পুরুষ জন্মাবে। কিছু দূর এগুতেই একদল লোক নৌকাটাকে তীরে ভিড়াতে বললো। মাঝি নৌকা ভিড়াতেই ওদের মধ্য থেকে একজন যাত্রীদের বলল, ‘সামনে বিপদ। একদল মুসলমান নৌকা থেকে হিন্দুদের নামিয়ে জাবাই করে ফেলছে। আপনাদের মধ্যে যদি কোন হিন্দু থাকে তো এখানে নেমে যান।’ যাত্রীদের কেউ নামলো না। বাঁচার আশায় একা কানুই নৌকা থেকে নেমে গেল। যদিও কানু জানে নৌকায় আরো তিন জন হিন্দু যাত্রী আছে। সে ভেবেই পেলো না কেন ওরা নামলো না।
৪.
হরি ডাক্তারের চোখে এখনো অবিশ্বাসের চিহ্ন স্পষ্ট। কোঁচটা তার বুকে গেঁথে আছে। হরি ডাক্তার দরজার বরাবর একটা চেয়ারে বসে ছিলো। মোতালিব এসে সরাসরি দরজা থেকে কোঁচটা তার বুকে গেঁথে দিলো। কোঁচ বুকে বেঁধা অবস্থায় তাকে টেনে উঠানে নিয়ে আসা হয়েছে। রান্না ঘর থেকে কাঠ এনে ঐ অবস্থায় হরি ডাক্তারের গায়ে আগুন দেওয়া হলো। একই দিন ঐ গ্রামে নিহত হলো প্রফুল্ল সেন ও তার দুই ছেলে, দক্ষিণ পাড়ার বিধু ধর। আর গ্রাম থেকে অনেক দূরে খালের পাড়ে তিরতির করে কাঁপছিলো একটি মস্তকহীন শরীর।
সবুজ পায়রা
বছর কয়েক আগের ঘটনা
তার সাথে আমার আংশিক প্রেম ছিলো। সে প্রতিদিন একটা সবুজ রঙের পায়রায় চড়ে আসতো; সচরাচর পায়রা কিম্বা কবুতরের রঙ সবুজ হয় না। কিন্তু তার পায়রাটি ছিলো মহান সবুজ। আবার এরকমও হতে পারে, হয়তো সে খুব ইম্প্রেশনিস্ট। ফলে তার সবুজ রঙের শাড়ির আভা প্রবলভাবে পায়রার উপরও পড়তো। এনিওয়ে, আমার সেই প্রেমিকার তাজমল দেখার খুব সখ হয়েছিলো একবার। সামর্থ থাকলেও আমি তাকে মহলটি দেখাতে অস্বীকৃতি জানাই এবং পরিবর্তে একটি নিবিড় প্রস্তাব দেই। কিন্তু আমার আন্তরিক প্রস্তাবটি তার কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর মনে হয়; ফলসরূপ সে আমাকে তৎক্ষনাত লিভ করে। তখনই বুঝতে পারি সেও আসলে আরেকজন টিপিক্যল উইম্যানই ছিলো। সে জন্যই বলি, প্রথাগত প্রগতিবাদি বালিকাদের উচিত কবিদের এভয়েড করা। অথচ বারবার সবুজ বালিকারা তাজমহল আর কবিদের প্রতিই অনুরক্ত হয়ে পড়ে।
ইদানিং আমার আশেপাশে আরেকটা সবুজ পায়রার নিবিড় ওড়াওড়ি ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। সেও কি আমার কাছে তাজমহল দেখার বায়না ধরবে?
রথযাত্রা
লোকে লোকারণ্য। রথের দড়ির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সবাই। রথ টানলে স্বর্গ নিকটবর্তী হয়। পূণ্যার্থীদের পদভারে রাস্তা কম্পিত। এই তুমুল ভীড়েও ওদের মধ্যে চোখাচোখি হয়ে যায়। পরষ্পর কাছে আসে। পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। ভীড় ওদের আলাদা করতে চায়;
এবারের রথটি বেশ বড়সড়; নানা বর্ণের ফুল ও জরিতে সুসজ্জিত। ছয়টি চাকা; বেদীটি বেশ প্রশস্ত, ক্রমেই মঠ আকৃতি নিয়ে উপরে উঠে গেছে। চূড়ায় স্থাপিত সিংহাসনে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামদের অধিষ্ঠান। পাশে বিরাজ করছেন পুরহিত সকল। সেখান থেকে মুষ্ঠি মুষ্ঠি ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে বাতাসা, কলা ইত্যাদি। ঈশ্বরের প্রসাদের জন্য হুড়োাহুড়ি লেগে যায় স্বর্গ প্রত্যাশীদের মধ্যে।
এই উত্তেজনা ওদের স্পর্শ করে না। ওরা ক্রমশ ঘনিয়ে আসে নিজেদের মধ্যে। একে অপরের স্পর্শ পেতে চায়; সাহস হয় না। এককাঁদি কলা নিয়ে আমি ভীড় থেকে আলাদা দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটি জানবে না ছেলেটির বাম পাঁজরে একটি হাড় নেই। ছেলেটিও জানবে না মেয়েটির জন্মমৌণতা।
রথের পেছনের অংশের বেদি ফুলের মালা দিয়ে আড়াল করা। ভেতরে ছোটখাটো একটা কুঠরীর মতো। ওরা সন্তর্পণে সেই আড়ালের দিকে এগিয়ে যায়। প্রবল কস্তুরি ঘ্রাণের আহ্বানে ছেলেটি-মেয়েটি ঢুকে পড়ে সেই সংক্ষিপ্ত কুঠরিতে।
চারিদিকে হরিবোল ধ্বনিত হতে থাকে।
নতুন গান
ধরা যাক, কয়েকটি পুরুষ একটি বালিকাকে ধাওয়া করছিল। মেয়েটির গ্রীবা থেকে আমাদের কবিদের চিত্রকল্প সমূহ একে একে বিদায় নিচ্ছে। ফলে ক্রমেই মেয়েটির ‘মেয়েটি’ থেকে মেয়ে সূচক অস্তিত্ব লোপ পাচ্ছিলো।—এরকম একটি দৃশ্যকল্প মাথায় রেখে এবার আমরা একটি গ্রাম্য বাজারে প্রবেশ করি। বাজারটির একটি নাম দেওয়া যাক। ধরলাম বাজারটির নাম কালীবাজার। বেশ পুরোনো; দেশান্তরী হওয়ার আগে হিন্দুরা এখানে রক্ষাকালীর পুজা করতো বিধায় এই নাম দেওয়া হয়েছ। কয়েক বছর ধরে অবশ্য বাজারটির নাম পরিবর্তন করে কাশেম বাজার রাখা যায় কিনা এরকম একটা আলোচনা আলোচ্য বাজারের মধ্যবর্তী কালী গাছটির ডাল পালায় ওড়াওড়ি করছিল। ইতিমধ্যেই অশ্বত্থ পেঁচানো কালী গাছটির কয়েকটি শাখায় বটের পাতাও গজাতে শুরু করেছে।
এবার চোখ ফেরানো যাক বাজার সংলগ্ন গেইট অলা বাড়িটির দিকে। গেইটের লালাটে স্পষ্ট আরবি হরফে ‘আল্লাহু’র জ্বলজ্বলে ক্যালিওগ্রাফি শোভা পাচ্ছে। এই ক্যালিওগ্রাফি থেকে আধামাইল উত্তর পশ্চিমে ধাবমান বালিকার অবস্থান—এটা মাথায় রেখে আমরা বাড়িতে প্রবেশ করবো। তার আগে বাড়ির গেরস্থের একটা পরিচয় দেওয়া যাক। বাড়িটির বর্তমান মালিক যথাযথ প্রক্রিয়ায় নামের আগে হাজী শব্দটি যুক্ত করেছেন সতের বছর হয়। অভিজ্ঞ পাঠকদের নিশ্চই মনে আছে আজ থেকে সতের বছর আগের সেই বিশেষ বছরটির কথা? সে বছর আমাদের ভারতীয় পড়শিরা রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিয়েছিলেন। আর তার সুবাতাস এসে লেগেছিল আমাদের এই কালীবাজারেও। ধীমান পাঠক, এটিকেও মাথায় রাখবেন। হাজী সাহেব পড়াশোনা করেছেন অবশ্য প্রবাসের মাদ্রাসায়। পাঠক, এখানে প্রবাস মানে কালীবাজারের বাইরের এলাকা। যেদিন তিনি প্রবাস থেকে গ্রামে প্রত্যাবর্তণ করেন তার দুই দিন পর সফির দোকানে পরোটা খেতে খেতে আমরা জানতে পারি, ‘ছোবান মিয়া বৈদেশ থিকা হাফেজ হইয়া আইছে। লগে দুগা বিবি আর জমজমের পানিও আনছে। হেরে অহনত্থুন আজি সাব কই ডাইকতো অইবো।’ এখানে একটি কথা বলে রাখি, বেশী নয়, তিন পুরুষ আগে হাজি সাহেবের বাপের দিকের কোন এক মহিলা সম্ভ্রান্ত কায়েস্থ ঘরের কনিষ্ঠা কন্যা ছিলেন।
এখন আসি যে বছর রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের পড়শিরা উন্মাদ হলো, সে বছর এ গ্রামের এক দুপুরের ঘটনায়। শিবু ধরা পড়েছে। বেঁধে রাখতে হয়নি, সুযোগ থাকলেও সে পালায় না। শ্রীমান শিবুর পরিচয় হচ্ছে সে এ গ্রামের সবচেয়ে বর্ষিয়ান চোর। এটা উত্তরাধিকার সুত্রেই প্রাপ্ত। পাকা হাত। যাক সে কথা। বিচার বসেছে। শান্তি বাবু সহ অন্যান্য সালিসদাররা এখনো এসে পৌঁছাননি। এরই মধ্য শিবুকে তৃতীয় বারে মতো উত্তম-মধ্যম হজম করতে হয়েছে। চতুর্থবারের সময় সে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। উৎসাহীরা কিি ত ভয় পেয়ে নিরস্ত হয়। ভীড় থেকে সহমর্মী একজন শিবুকে একটি স্টার সিগারেট ধরিয়ে দেয়। সিগারেট টানতে টানতে শিবু এবং উৎসাহীরা সালিসদারদের অপেক্ষা করতে থাকে। প্রিয় পাঠক, দয়া করে ঐ বালিকাটির কথা ভুলে যাবেন না।
অনেক তো ধান ভানলাম, এবার নিজের পরিচয়টা দিই। আমি গান লিখি। প্রচলিত আছে ব্যর্থ কবিরাই নাকি গান লেখে। আমিও কবিতায় বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে কিছু দিন হলো গান বাঁধতে শুরু করেছি। নিজে লিখি, নিজেই সুর করি। আমি অবশ্য কালীবাজার অ লের বাসিন্দা নই। থাকি ভিন্ন গাঁয়ে। এমনকি গল্পের প্রথম থেকে যিনি রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন আমি তাঁর কেউ নই। অথবা যারা তাঁকে ধাওয়া করছে তাদের সাথেও আমার কোন পরিচয় নেই। আমি শুধু একটি গান লেখার অপেক্ষায় আছি। একটি নতুন গান। যে গানে কোন উপমা থাকবে না। রাগ রাগীনির শৃঙ্খল থাকবে না। সুর লয় তাল কিছুই থাকবে না। কিন্তু সেটা গান হবে এবং সমবেত ভাবে গাওয়া যাবে। আমার নিবাস আমার এই আকাক্সক্ষার মধ্যে।
সেদিন সালিসদাররা যে কারণে আসেনি—রাতেই তারা রেডিওতে খবর পেয়েছিল বিজেপি-শিবসেনার হনুমানেরা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলেছে, ফলে সারা ভারতে এবং বাংলাদেশে অনুমেয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছে। সঙ্গত কারণেই সেদিন সালিসি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা আর তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এদিকে সালিশের জন্য অপেক্ষারত শিবু চোরা এবং অন্যান্যরা কিছু বুঝে উঠার আগেই হাজী বাড়ির ভেতর থেকে কালীবাজারের উপরে নরক নেমে এসেছিল। রক্ষাকালীর আস্তানায় শেষবার রক্তের হলি খেলা চলেছিল ঠিক পৌনে এক ঘন্টা। এদিকে হাজী বাড়ির গেইট থেকে আধা মাইল উত্তর পশ্চিমে যে মুসলিম বালিকাটি ধর্ষিত হচ্ছিল তার কিছু দূরেই দাউদাউ জ্বলছিল একটি সম্ভ্রান্ত কায়েস্থ বাড়ি।
প্রিয় পাঠক, ধরে নিন বালিকাটি এখন তিন সন্তানের জননী। সব অতীত এখন, কালীবাজারও। আমি কাশেম বাজারের বাসিন্দা নই বলে আমার সাথে তার কোন সম্পর্ক তৈরী হয়নি—না রক্তে, না ধর্মে। এমনকি তার সাথে আমার কোনদিন দেখাও হয়নি। কিম্বা সে আমার প্রণয়নীও ছিল না কোন কালে। কিন্তু সতেরটি বছর ধরে আমি ঐ ধাবমান বালিকাটির জন্য একটি নতুন গান লেখার অপেক্ষায় আছি। কারণ এখনো আমি তার চোখে ভয়-কাতর হরিণের খুরের শব্দ শুনতে পাই।
লোকটির ব্যক্তি হয়ে ওঠা
লোকটি হাঁটছিলো। না, ‘লোক’ নয়, ‘ব্যক্তি’টি হাঁটছিলো—ঠিক যেন পথিক। অর্থাৎ লোকটি পথিকের মতো হাঁটছিলো। বঙ্কিমবাবু হলে হয়তো বলতেন—পথ হারাইয়াছ বাছা? কিন্তু আমি পথিকের চিন্তায় ব্যকুল নই। আমি ভাবছি হারামজাদাটা এই ভর দুপুরে এখানে ঘুরঘুর করছে কেন! বিষয়টা বেশ সন্দেহজনক। নাহ্, একে ব্যক্তি বলা যাবে না; ‘সন্দেহজনক’ শব্দটির সাথে ‘লোক’ শব্দটিই মানাসই।
০১.
লোকটি যখন জীর্ণ মাদার গাছটির নিচে এসে দাঁড়ালো (দারুণ তো! ‘লোকটি’, ‘গাছটি’ কেমন মিলে গেলো) অমনি আশ্চর্য এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটলো: অ্যানিমেটেড সিনেমার দৃশ্যের মতো গাছটির শীর্ণ কাঁটাগুলি আরও স্পষ্ট হতে লাগলো, দাউদাউ আগুনের উল্লম্ফনে গাছটির সমস্ত ডাল লালফুলে মেতে উঠলো। আর কী আশ্চর্য, লোকটির লুঙ্গির প্রতিটি রিপুর দাগ গুচ্ছ গুচ্ছ মাদার ফুল হয়ে জ্বলতে লাগলো আমারই চোখের সামনে।
০২.
‘পুকুর পাড়ে বসে হারামজাদাটা কী ভাবছে?’—এ চিত্রকল্পটি ভাবতে ভাবতেই লোকটি এসে সত্যি ডোবার পাড়ে এসে বসলো। ডোবাটি ব্যবহৃত হয় হাসপাতাল পাড়ার ডাস্টবিন হিসেবে। ফলে এখানে জমে ওঠে, পচে ওঠে আমের খোস ও আঁটি, মাছের কানকা, মরা বেড়ালের ছানার সাথে মানুষের অসম্পূর্ণ ছানার ছাইপাঁশও। সেই পুঁতিময় নোংরা যায়গায় লোকটি বসলো বেশ আয়েশ করেই। হারামজাদার বসার ভঙ্গিটা তো বেশ অশ্লীল—হাঁটুর বেশ উপরে লুঙ্গি তুলে বেশ উদাস ভঙ্গিতে চিপায় চুলকাচ্ছে। আরামে বেটার চোখ বুজে আসছে। কিন্তু একী! চুলকানি সংক্রান্ত ক্রিয়াকর্ম শেষে লোকটি যেই ডোবার দিকে তাকালো অমনি ডোবাটি রূপান্তরিত হয়ে গেল টলটলে দিঘিতে। সেখানে আপন মনে একটি পানকৌড়ি ডুবসাঁতার খেলছে।
০৩.
এবার লোকটিকে এনে দাঁড় করিয়ে দিলাম এক হাইব্রিড মাঠে। দেখি হারামজাদা এবার কী করতে পারে। ওমা, বদমায়েশটা মাঠের দক্ষিণ কোনায় গিয়ে স্মরণীয় ভঙ্গিতে বসে পড়লো। পানি বিয়োজন শেষে যেই সে উঠে দাঁড়ালো, কংক্রিটের মাঠ পরিণত হলো সবুজ ঘাসের মদিরকার্পেটে। সেখানে এখন মাঝে মাঝে পেঁচা কাঁধে বৈকালিক ভ্রমণে বের হ’ন কেউ কেউ।
০৪.
লোকটাকে আমি শেষমেশ রাস্তায় এনে ছেড়ে দিলাম। সে পাশের টি-স্টলে ঢুকে একটা বিড়ি ধরাল এবং যথারীতি সেই বিড়ি থেকে ধোঁয়ার বদলে কলকল করে এক ঝাঁক শিশু হামা দিয়ে উড়ে গেল অনতিদূরে অপেক্ষমাণ একটি কিন্ডারগার্ডেনের দিকে।
০৫.
অতঃপর, সে পুনরায় পথিক হয়ে গেল। মানে শহরের সব চেয়ে ব্যস্ত সড়ক ধরে নির্বিকার হাঁটাহাঁটিতে মনোনিবেশ। তাকে তখন অবিকল রূপসীবাংলার মতো দেখাচ্ছিল। একবিংশ শতকের ট্রাক তাকে চাপা দিতে উদ্যত হতেই মুহূর্তে সেটি পরিণত হলো ব্যালেনৃত্যরত সুনীল রাজহাঁসে—এ দৃশ্যটি অবশ্য আমি নিজে দেখিনি। আমারই এ অসেক্যুলার বন্ধু একটি হলুদ ব্যাঙের চোখে এ দৃশ্য দেখেছিলো মেডিকেলের হিম ড্রয়ারে বসে।
একটি সংক্ষিপ্ত কেস স্টাডি
লাবিব সহেবের বাচ্চা হয়েছে আজ তিন মাস। বাড্ডার একটা ক্লিনিকে সিজারে হয়েছে। মেয়ে হওয়াতে ওরা খুব সুখী। লাবিবের স্ত্রী সায়রা একটা কলেজে পড়ায়, এখন মাতৃত্বকালিন ছুটিতে আছে।
কিন্তু বিপত্তি ঘটলো কয়েকদিন পর। লাবিব সাহেব প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে ঘরে অন্ধকারে একটি ছায়ামূতির্’র অস্তিত্ব টের পান। একদিন, দুইদিন, তিনদিন…। মধ্যরাতে একটা নারীমূর্তি ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু চোখ দু’টো স্পষ্ট দেখা যায়। আর সব আবছা আবছা। তিনি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন নারীমূর্তিটি দেখতে ঠিক সায়রার মতো। তিনি বুঝতে পারেন এটা এক ধরণের বিভ্রম। বিষয়টা সায়রাকে জানান।
একরাতে তারা দু’জন রাত জেগে থাকেন। ঠিক মধ্যরাতে সায়রার একটু তন্দ্রার মতো এসেছিলো। লাবিবের হাতের স্পর্শে ঘুম ভেঙ্গে যায়। লাবিব বলেন তিনি ছায়ামূর্তিটিকে দেখতে পাচ্ছেন। সায়রা ঘরের কোণে কিছুই দেখতে পায় না। লাবিব প্রচ- রকম ঘামছে। সায়রা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে; লাবিবও বলেন, তিনিও বুঝতে পারছেন এটা তার মানসিক বিভ্রম। তবু তিনি সায়রার ছায়ামূর্তিটি দেখতে পাচ্ছেন। তিনি বুঝতে পারছেন এই মুহূর্তে বাস্তব ও বিভ্রম যুগপৎ তার মস্তিস্কে ক্রিয়াশীল। তিনি এই বিভ্রম থেকে বেরুতে চাচ্ছেন। লাবিব হঠাৎ সায়রার গলা চেপে ধরেন এবং সাথে সাথেই সম্বিৎ ফিরে পান।
পুরো বিষয়টা বিপদজনক দিকে মোড় নিচ্ছে দেখে তারা মনরোগ বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হন। ডাক্তার সমস্ত ঘটনা শুনে আনুষাঙ্গি কিছু প্রশ্ন করে দুইদিন পর তাদের আসতে বলেন। এ ফাঁকে যে হাপাতালে সায়রার ডেলেভারি হয়েছিল ডাক্তার তাদের সাথে যোগাযোগ করেন।
দ্বিতীয় দিন যখন লাবিব-সায়রা দম্পত্তি বাচ্চা কোলে নিয়ে আসেন, তখন তিনি বাচ্চাটিকে দেখতে চান। কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণে তারা বাচ্চাটি দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং দ্রুতই ডাক্তারের চেম্বার ত্যাগ করেন।
ডাক্তার তার সংক্ষিপ্ত কেইস স্টাডিতে লিখে রাখেন—তিন মাস আগে বাড্ডার একটি ক্লিনিকে মিসেস সায়রা একটি মৃত সন্তান প্রসব করেছিলেন।
পা
মেয়েটি একটি কিন্ডারগার্ডেনে পড়ায়। বছরখানেক আগে একটা এক্সিডেন্টে বাম পায়ের গোড়ালিতে আঘাত পায়। সে সময় তার প্রেমিকটিও সাথে ছিল। সৌভাগ্যক্রমে প্রেমিকটি অক্ষত থাকে। কিন্তু ওর গোড়ালির হাড় এমন ভাবে ভেঙ্গে গিয়েছিল যে সে আর সুস্থ হতে পারে নি। ফলে এখন সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। খোঁড়া মেয়েকে ঘরের বৌ করা যাবে না—পরিবারের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে প্রেমিকটি কিছুদিন পর অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে।
ওদের বাড়ি পাশাপাশি। প্রতিদিন সকালে ওকে প্রেমিকটির বাড়ির সামনে দিয়েই স্কুলে যেতে হয়। ঠিক এই সময়টাতেই প্রেমিকটি জগিং শেষ করে বাসায় ফেরে বলে প্রায়ই ওদের দেখা হয়ে যায়। এ কারণে ওকে এ পথটুকু রিক্সায় যেতে হয়।
মেয়েটির রাত কাটে ইনসোমনিয়ার দুর্বোধ্যতায়। এলাকার এক মাস্তানের সাথে সখ্য গড়ে ওঠে তার। কয়েকটি সন্ধ্যা মাস্তানটির কাছে বিনিয়োগ করার পর সে জানতে পারে, কে বা কারা যেন প্রেমিকটির বাম পায়ে গুলি করে। হাসপাতালে তার হাঁটু থেকে নিচের অংশ কেটে ফেলতে হয়।
এখন মেয়েটি প্রতিদিন হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যায়। প্রেমিকটি হুইল চেয়ারে বসে রোজ সকালে এই দৃশ্য দেখে।
সরল দোলক
পল ও পম্পা পিঠাপিঠি ভাইবোন। পম্পা এক ক্লাশ উপরে পড়ে। ওদের কোচিং কাছাকাছি হওয়ায় দু’জন এক সাথে যাওয়া আসা করে। ফিরতে ফিরতে ওদের সন্ধ্যা হয়ে যায়। দুই ভাইবোন একসাথে থাকাতে বিশেষ ভয় লাগে না।
পলের চেহারায় এখনো পুরুষসুলভ কাঠিন্য আসেনি। ওদের যাত্রা পথে স্থানীয় কয়েকটা ছেলে তাদের ইংগিত করে নানা কথা বলে। একদিন পল অসুস্থ থাকায় পম্পা একা একা এই দুস্তর পথ পাড়ি দিয়েছিল এই ভয়ে যে ওকে একা পেয়ে ছেলেগুলি ‘কি জানি কী’ আচরণ করে। নির্বিকার সিগারেট টানা ছাড়া ছেলেগুলোর আর কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি সেদিন।
এর মধ্যে একদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে ছেলেগুলো পলকে তুলে নিয়ে যায়। কয়েকটি গলিঘুপচি পেরিয়ে একটা রুমে ঢুকিয়েই সম্ভবত দলনেতা পলের ঠোঁটে কষিয়ে চুমু খায়। চুমু শেষে সবাই মিলে বিষয়টা চিয়ারআপ করে। এই ফাঁকে পল রুমটা ভালোমতো লক্ষ্য করে। একপাশে একটা পুরোনো সোফা, সিঙ্গেল বেডের একটা খাট, তাও শুধু মাত্র তোষক আছে কোনরকম। খোলা দরজা দিয়ে বাথরুমের বেসিনে কনডমের খোসা দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট একটা সিডিতে হাই ভল্যুমে শীলার চিকনা যৌবনের প্রশংসা ঝরছে। এদিকে সবাই পলের উপর নিজস্ব সুখ চরিতার্থ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই ফাঁকে একটু ধাতস্থ হয়ে নেয় পল। দলনেতাটিকে দাঁতব্রাশ করার অনুরোধ করে দুর্গন্ধহীন চুমু খাওয়ার বাসনা জানায়। পলের কথায় দলটি স্মরণকালের বিস্ময়ে ঢুকে পড়ে। সকলের হা-করা মুখ থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত রূমে। দম বন্ধ হয়ে আসে পলের। দলটির মধ্যে দুলে উঠলো ঘৃণার সাম্পান। পাথরিক স্তব্ধতা শেষে দলনেতাটি বলল, ‘লাত্থি মেরে এই বের করে দে এই কুত্তার বাচ্চারে।’ কয়েকজন পলকে চড় ত্থাপ্পর ও লাথি মেরে গলি থেকে বের করে দেয়। পল দুঃখিত মনে ঘরে ফিরে আসে;
বাসায় এসে দেখে পম্পা ওর এই সংক্ষিপ্ত অপহরণ সংবাদটি কাউকে বলেনি। পলও আর বলার প্রয়োজন বোধ করেনি।
পরদিন পলের ঘুম ভাঙ্গে মা’র ঘর মাথায় তোলা চিৎকারে। পম্পা গলায় ফাঁস দিয়েছে। সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়নায় ফাঁস দেওয়া মৃদু দোদুল্যমান শরীর পলের কাছে সরল দোলক ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। ও জানে, অভিকর্ষজ বলের কারণে পম্পার শরীর কোথাও উড়ে চলে যাবে না।
রাজারানীর গল্প
এক দেশে ছিল এক রাজা আর এক রানী। রাজার মনে অনেক দুঃখ—তাঁর কোন ছেলে ছিলো না, মেয়েও না। রানীর ছিল পাঁচ ছেলে। প্রত্যেকেই ভীষণ সুন্দর। ছিল মিথের মতো স্বতন্ত্র আর আদুরে। তবুও নিঃসন্তান রাজার দুঃখে রানী সব সময় দুঃখ পেতেন। রানীর গোপনে অকাল বর্ষা।
রানীর বড় ছেলের নাম ছিল রূপীলিকা। বয়স ছিল তিন দিন। ছোট ছেলের নাম ঙতি। ঙতির বয়স ছিলো দুই ঘণ্টা। কিন্তু রানী নিজের সন্তানের চেয়েও রাজাকে ভালোবাসতেন বেশি। তাই রানী একদিন ঙতিকে খেয়ে ফেললেন।
এখন রানীর চার ছেলে। আর রাজার এক ছেলে। ছেলে প্রাপ্তির ঘটনায় রাজা ভীষণ আনন্দিত। রাজ্যে মাসব্যপী পার্বণ ঘোষণা করলেন। রাজপুত্রের আগমনে রাজ্যের উৎসবের ধুম পড়ে গেল। রাজার আনন্দে রানীও খুব খুশি হলেন এবং আনন্দে তিনি রূপীলিকা সহ বাকি চার ছেলেদেরও খেয়ে ফেললেন।
এখন রাজার পাঁচ ছেলে। রানীর কোনো সন্তান নেই। রাজপুত্ররা যথাযথ ভাবে বেড়ে উঠতে লাগলো, রাজাও মনের আনন্দে রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন; রাজ্যের অধিবাসীরাও সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলো।
শুধু বন্ধ্যা রানী মুছে গেলেন গল্প থেকে।
কয়েকটি ভেড়া ও একটি মানুষ
উদ্ভিদগুলো উন্মুখ হয়ে আছে। মাটির ভেতরে বহুমাত্রিক মতবাদে ওরা অস্থির। শেকড় শুধু উপড়ে যেতে পারলে ভালো লাগতো। ভূপৃষ্ঠে মানুষের অশ্লীল পায়চারি ওদের ক্লান্ত করে দিয়েছে। সূর্যের কাছেও বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না। তাই ওরা ব্যাকুল হয়ে প্রতীক্ষা করছে কয়েকটি ভেড়ার জন্য।
একটি মানুষ আগাগোড়া আদিম। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে, আমাদের ঠিক জানা নেই তিনি কোন দৃশ্যের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধন করে আছেন। যাচ্ছিলেন মালিবাগ রেলগেইট থেকে মৌচাক মোড়ের দিকে; এর মাঝে মাঝপথে থমকে গিয়ে তার এই দৃষ্টিপাত। তিনি কি উদ্ভিদকূলের চিন্তায় ব্যাকুল? নাকি ভেড়ার পশমের ব্যবসায়?
ভেড়াগুলোও অস্থির হয়ে আছে। আড়াই দিন ধরে পশম গজাচ্ছে না। ইলেকট্রনিক ক্ষুরের কটাক্ষ সহ্য করার চেয়ে কসাইয়ের চাপাতিতে গলা পেতে দেওয়া সম্মানজনক মনে হচ্ছে। কাজীপাড়ার দিকে চলে যেতে পারলে ভালো হতো।
আজকাল মানুষদের কী যে হয়েছে—রাস্তার মোড়ে মোড়ে লেজ নাড়িয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ সঙ্গমের ভঙ্গি করছে। তারপর ঘনঘন বৃষ্টিপাত হয়—ওঁৎ পেতে থাকে।
আদিম মানুষটি সদ্য প্রস্ফুটিত দন্তযুগের বিভা নিয়ে মৌচাক এসে পৌঁছালেন। মাটির তলা থেকে অবমুক্ত হলো বেগুনি আলু। ভেড়াগুলোর পেটে বাস করতে লাগলো উদ্ভিদেরা; সুখে ও শান্তিতে।
আহ! নিউটনের আপেল, মিথের মতো ড্রপ খাও এখন দুনিয়ার তলপেটে। আদিম মানুষটি লজ্জা পেতে শিখে গেছেন। ভেড়াগুলোর প্রেগনেন্সি রুখতে হবে তোমাদের।
সাইকেল অথবা শৈশব
শব্দের ভেতর থেকে উড়ে গিয়ে পাখিগুলো গলি পেরিয়ে বসে আছে নিঃসঙ্গ সাইকেলটায়। হয়তো কোন কিশোর এখানে তার শৈশব রেখে গিয়েছিলো। বিকেলের শেষ আলোয় পাখিগুলো দখল নিলো সেই ফেলে যাওয়া শৈশবের। চাইলেই আমি একটি কালো বিড়াল লিখে দিতে পারি, যেটি অলিগলি পেরিয়ে রাস্তার অই পাড়ের সাইকেলটিকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু আমি তা লিখবো না। পাখিগুলো সেখানে বাসা বাঁধুক। করুক শিল্পের বড়াই।
আমার বারান্দা থেকে সাইকেলসহ পুরো রাস্তাই দেখা যায়। জনমনুষ্যহীন একটি ল্যাম্পপোস্ট আছে গলিটার অইপাশে। অইটাকেই আমার যত ভয়। রাত হলে ওখানে ঘন অন্ধকারে মাঝে মাঝে কয়েকটা জোনাক পোকা ওড়াওড়ি করে। অথচ ওখানে কোন চোরকাঁটার ঝোঁপ নেই, দিনের বেলায় আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি জায়গাটা। একটি বৈশিষ্ট্যহীন নষ্ট ল্যাম্পপোস্ট ভাবলেশহীন ভাবে মিলিসিপলটির অবহেলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধু।
২.
আমি বেড়ে উঠেছি মেছোদের গ্রামে। যে গ্রামে তখনো ইলেকট্রিসিটির আলো পৌঁছায়নি। আমাদের রাস্তাগুলো গ্রীষ্মে ছিলো ধবধবে বালুর সুগন্ধি আর বর্ষায় লেজের ঝাপটায় হয়ে ওঠে কর্দমাক্ত। ছেলেবেলা থেকেই রাস্তার আঁটশে বালু খাওয়া ছিলো ভীষণ প্রিয়। আমাদের আশান্বিত করে পল্লীবিদ্যুতের কাঠের খুঁটিগুলো দাঁড়িয়েছিল দীর্ঘদিন। তবে বিদ্যুত আসার আগেই খুঁটিগুলো চুরি হয়ে যায়। কাশফুলে ভূতের আবাস আর সন্ধ্যার পর শ্মশানের ফসফরাসে ভূতের লুয়ার গল্প শুনতে শুনতে আমাদের ঘুমিয়ে পড়তে হতো। রাতে শেয়াল বাগডাস আর নানা রকম শব্দের ঝনঝনানিতে ঠাকুরমার ঝুলিতে ঢুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতাম। সন্ধ্যায় খালপাড়ে চোরকাঁটার ঝোঁপে জোনাকগোটার আলোর সংরাগ ছিলো বিস্ময়ের প্রধান কারণ। প্রায়ই জোনাক পোকা ধরে এনে কাঁচের বয়ামে ভরে ঘরে সাজিয়ে রাখতাম। সেই গ্রাম থেকে আমাকে তুলে এনে একদিন আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হল ভাঙ্গাচোরা ইশকুলে। দীর্ঘ বাঁশতলা পাড়ি দিয়ে বাজারের কাছাকাছি এলে আমারা হাঁপ ছেড়ে বাঁচতাম। ইশকুলে যেতে হতো কসাইয়ের দোকানের সামনে দিয়ে, ফলে গোস্ত কাটার শব্দের ভেতর মাংসের আহ্বান, আর রক্তের স্রোত ডিঙ্গিয়ে ইশকুলটাকে বড় বেশি বিষাক্ত মনে হতো। মনে হতো, এই বিষাক্ত ভ্রমণ অতিক্রম করে আমি শুধু হাত পেতে মাস্টার মশায়ের বেত খেতে যেতাম। ইশকুল শেষে বাড়ি ফিরতে প্রায়ই আমার সঙ্গী হতো সুজিত। আমার বাবা বাজারের মুদি দোকানদার। সবাই তাকে সওদাগর বলে ডাকতো। সুজিতদের বাকীর খাতা ছিলো আমাদের দোকানে। চারপাশে জঙ্গলের অদ্ভুত ডাক, শেয়াল আর ঝিঁঝিঁ, চোরকাঁটা গাছে জোনাক পোকার অগ্নিনৃত্যÑ আমি কি সেই শৈশবেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম ওর? ও— মানে কি সুজিত? নাকি অন্য কিছু?
৩.
গ্রামের নির্জন বালুময় রাস্তায় সাপ আর ব্যাঙের ভয় ছিল না কখনোই। সাপ দেখে নাটুকে ভয় পেয়ে বসেনি। অথচ শেষ বিকেলের লাল আলোয় সাইকেলটিকে গলগল করে গলতে দেখে খানিকটা ভয় হতে লাগলো। মনে হচ্ছে যেন ছেলেবেলার জলপাই গাছের আগুনের স্রোত গলির সমস্ত বাঁক অতিক্রম করে আমার বারান্দার দিকে এগিয়ে আসছে। যদিও বুঝতে একটুও দেরি হয়নি যে আমি এক ধরণের সাময়িক বিভ্রমের ভেতর ঢুকে পড়েছিলাম। সাইকেলটিকে এখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অথচ সন্ধ্যা নেমেছে অনেক্ষণ হয়। বরং এর সাথে নতুন যে উপাদান যুক্ত হয়েছে, উপাদান না বলে জীব বলাটাই শ্রেয়তর হবে, সেটি হচ্ছে একটি ছাই রঙের বেড়াল। এটি কোত্থেকে উদয় হলো, বুঝতে পারছি না। কারণ আমি তো আঁকতে চেয়েছিলাম কালো রঙের বেড়াল। তবে কি রঙের মিশ্রণ ঠিক মতো হয়নি। নাকি সে নিজেই কালোর সাথে পরিমাণ মতো সাদা মিশিয়ে ছাই বর্ণে অঙ্কিত হয়েছে?
৪.
এবার কিন্তু আমার কোন ভয় করছে না। কারণ গলিত সাইকেলটির পাশে পায়চারিরত বেড়ালটিকে আমার সুজিত বলে মনে হচ্ছে। খানিক পরপর ও অভয়ের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে। ওর চোখের কোটরে, নাক ও কানের গর্তগুলোয় জোনাক আলো জ্বলছে আর নিভছে; কী আশ্চর্য পাশের রুমের হ্যাঙ্গারে টাঙানো ওর ব্যবহৃত শার্ট, জাঙ্গিয়া, সেন্টোগেঞ্জি থেকে ভেসে আছে জঙ্গলিগন্ধ। সাইকেলের পাশ থেকে বেড়ালটি যতবার আমার দিকে তাকাচ্ছে ততোবারই বারান্দার গ্রিলগুলো হয়ে যাচ্ছে কলমি গাছের নরম ডাল। চাঁদের আলোয় গলিত সাইকেলটি কেমন জীবন্ত হয়ে উঠছে; মনে হলো, গলিত সাইকেল আর বিড়ালটিকে অনেক গোপন কথা বলার আছে। আমি দ্রুতই দুই কাঁধে দুইটি ডানা এঁকে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু কী নিষ্ঠুর আকাশ! চাঁদ হঠাৎ মুখ লুকালো মেঘের আড়ালে। যখন মেঘ সরে গেল সমস্ত ষড়যন্ত্র শেষ করে, তাদের আর দেখতে পেলাম না। সাইকেল কিম্বা শৈশব কিম্বা ছাই রঙের বেড়ালের বিন্দুমাত্র চিহ্ন সেখানে ছিল না।
বাঁশিওলা
প্রতিটি শহরেই একজন বাঁশিওলা থাকে। যার বাঁশির সুরে মহিত হয়ে পড়ে শহরের ইঁদুরগুলো। তারপর দুর্ভাগ্য নেমে আসে বালক-বালিকাদের নিভাঁজ শৈশবে। যে শহরের প্রান্তে পাহাড় থাকে না, সে শহরের বুক চিড়ে বয়ে যায় দুঃখের নদী। দুইকুল প্লাবিত জ্যোৎস্নার ঢেউ বুকে টেনে নেয় সবুজের কোলাহল।
আমি সেই কৈশোর থেকে একজন বাঁশিওলাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। যার সুরের মোহন টানে আমি আর ইঁদুরগুলো লুটোপুটি খেতে খেতে বেড়িয়ে পড়বো, কাছেই জালছেঁড়া নদী, একটু দূরে গেলে মেঘনার সন্ত্রাস। বাঁশিওলা এলেন না। আমিও কিংবদন্তির ভেতর ডুবে মরতে পারলাম না। ইঁদুরগুলোর না হয় বিষের ব্যবস্থা আছে, আছে ইঁদুর ধরার কল।
আমি কি তবে হ্যামেলিনের অবশিষ্ট শিশু? নিদ্রাহেতু শুনতে পাইনি বাঁশির অমিয় আহ্বান? সেই অভিশাপে আজো বেঁচে আছিÑ অল্প অল্প সুর শিখে নিয়েছি; হ্যাট মাথায় এ শহরে দুপুর কি মাঝরাতে, যদি কাউকে দেখা যায় বাঁশি হাতেÑ সাবধান ভুলেও তার কাছে সুর শুনতে চাইবেন না। আপনাকেও আমি হয়তো মোহিত করে ফেলতে পারবো, নিয়ে যাবো সোন্দলপুর কিম্বা টাঙ্কির খাল। উপকূলীয় সে জ্যোৎস্না সর্বগ্রাসী খুনে উল্লাসে জড়িয়ে ধরবে চিরতরে।
তার চেয়ে বরং কবীর সুমন এর গান শোনা যাক—মানুষ জমেছে দাবী গরাদ ভাঙ্গার, ভাঙ্গে যেন জানালার গরাদ সবার…
মহাপ্রস্থান
লোকটি হাঁটছিলো। তার হাঁটার মধ্যে কোন সংশয় ছিলো না। প্রত্যেকটি পদক্ষেপে নতুন করে পথ তৈরী হচ্ছিলো। তার সামনে ছিলো দিগন্তরেখার অক্ষয় দূরত্ব, পেছনে একদল আক্রান্ত নাগরিক; যারা তাকে নগর থেকে সম্প্রতি বহিস্কার করেছিলো। বহিস্কারের কারণ খুব পরিষ্কার। সে একটি মহামিথ্যা দাবী করেছিলো। প্রথমে তার এই মিথ্যাকে কেউ পাত্তা দিতে চায়নি। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর এত দৃঢ় ও নিঃসংশয়ী ছিলো যে নগরীর পুরুষ ও নারীরা সম্মিলিত ভাবে বিচলিত হয়ে পড়েছিলো। নিজেদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলো; অতীতের দিকে চেয়ে শিউরে উঠেছিলো। তাদের মধ্যে একজন প্রস্তাব করেছিলো, “ওর দাবীটি অসাংবিধানিক ঘোষিত হোক।” যেহেতু এ দাবীর ফলে সে তার রমনীর সাথে মৌলিক সঙ্গমে লিপ্ত হতে পারছিলো না। একজন— যিনি সম্প্রতি নগরীর নিরপেক্ষ ইতিহাস প্রণয়ন করেছিলেন—প্রস্তাব করেছিলেন, ‘ওর মস্তক মুন্ডন করে দেওয়া হোক; না হলে ওর জবড়জঙ চুলের দুর্বোধ্যতায় আমাদের তরুণ-তরুণীরা নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে।’ একজন প্রফেসর তাঁর সুকুমার চশমা কানে এঁটে অত্যন্ত উজ্জ্বল ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কেন ওর পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। অবশেষে একজন, যাত্রাপালার বিবেক হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন যিনি, স্বপ্রণোদিত হয়ে লোকটির দিকে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন যে, ‘কেন তার এই দাবীটি মিথ্যা ঘোষিত হবে না’? লোকটি জানালো, ‘আমি সত্য বলছি’। ‘কিন্তু এটা নগরীর নর-নারীর বিশ্বাসের পরিপন্থী।’ ‘বিশ্বাস অবৈধ’ লোকটি ঘোষণা করল।
অবশেষে সাব্যস্ত হলো, এই কলঙ্কিত উৎপাতকে বহিস্কার না করলে নগরীতে আর কোনদিন বৃষ্টি আসবে না। নারী ও পুরুষ এই সিদ্ধান্ত সবিস্তার শুনে স্বস্তিতে ভরে উঠলো। তারা পুনরায় একটি নিরুদ্বিগ্ন জীবনযাপনে মনোনিবেশ করলো।
হাঁটতে হাঁটতে লোকটি তখন অনেক দূর চলে গিয়েছিলো। তার পেছনে দূরবর্তী নাগরিকগণ আর সামনে অস্তমান সূর্যের নিদ্রালু আলো। তিনি সেই সূর্যকে পেছনে রেখে ফিরে তাকালেন প্রস্থান-পথের সূচনা বিন্দুতে, বৃষ্টি বিধ্বস্ত একটি মাটির ঢিবির দিকে। সেদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি শুধু একটি অনাথ বালকের পিতৃত্ব দাবী করেছিলাম, যাকে তোমরা ক্রুশে গেঁথে হত্যা করেছিলে।’
- কয়েকটি ভেড়া ও একটি মানুষ : প্রণব আচার্য্য প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত, প্রকাশক: বাংলা বই, পরিবেশক: প্লাটফর্ম, মূল্য: ১০০ টাকা