চিন্তাসূত্র ডেস্ক
শিগগিরই মলাটবন্দি হয়ে আসছে তরুণ কথাশিল্পী-ছোটকাগজ সম্পাদক হারুন পাশার উপন্যাস ‘তিস্তা’। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের তিস্তা নদী নিয়ে বাংলাদেশে এটিই প্রথম কাজ। ‘তিস্তা’ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে মৃতপ্রায় তিস্তার তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষের জীবন। যারা মাছ ধরা ও কৃষিকাজসহ নদীনির্ভর বিচিত্র পেশায় নিয়োজিত। কিন্তু পানি ক্রমশ কমে যাওয়ায় এক সময়ের ভরা তিস্তা খালে পরিণত হলে তাদের অস্তিত্বসংকট তীব্র হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের পেশা বদলাতে বাধ্য হয়। কেউ খাস জমিনে আশ্রয় নেয়, কেউ কেউ পাড়ি জমায় ঢাকায় বা অন্য কোথাও। কিন্তু স্বাবলম্বী হতে পারে না কেউই। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই তারা তিস্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তারা তিস্তার পানির জন্য আন্দোলনে নামে। নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে গর্জে উঠে সাধারণ মানুষ। তারা তিস্তা চুক্তির আশায় দিন গোনে। নদী ও মানুষের জীবনসংকট মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এই ‘তিস্তা’ উপন্যাসে।
উল্লেখ্য, ‘তিস্তা’ ধারাবাহিকভাবে চিন্তাসূত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। ‘তিস্তা’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ার পর দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক তাঁদের অভিমত দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক-গবেষক আহমদ রফিক বলেছেন, ‘‘তরুণ হাতের রচনা ‘তিস্তা’ উপন্যাসটি সুলিখিত, আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য নিয়ে। মাঝে মধ্যে দর্শকের বক্তব্যে কিছু শৈল্পিক নাটকীয়তার প্রকাশ। লেখকের চেষ্টা এতে বহুমাত্রিক চরিত্রগুলোর সংযোজন ঘটানো। হারুন পাশা সেকাজটি যথাযথভাবেই সম্পন্ন করেছেন। বিশেষ করে তিস্তাপাড়ের দুর্দশা-পীড়িত মানুষের জীবননাট্যের ট্রাজিক চিত্ররচনায়। সেখানে ঐতিহ্যধারারও রয়েছে বিশেষ ভূমিকা।’’
অধ্যাপক ও গবেষক হায়াৎ মামুদ বলেছেন, ‘‘হারুন পাশা-র রচনার সঙ্গে আমার পূর্ব-পরিচয় ছিল না। তিনি কতদিন ধরে লিখছেন, আমার জানা নেই, কিন্তু ‘তিস্তা’ পড়ে উঠে দেখলাম সাধনার স্পষ্ট ছাপ। ভাষাভঙ্গি অনবদ্য। বর্ণনাকৌশলে রয়েছে নতুনত্বের ছাপ। আঞ্চলিক কথ্য ভাষারূপ পাঠককে তৃপ্তি দেয় তো বটেই, অধিকন্তু শ্রবণপিপাসা জাগ্রত করে। আমার বিশ্বাস, ‘তিস্তা’ উপন্যাস আমাদের কথাসাহিত্যে হারুন পাশাকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং তিনি দৃঢ়চিত্তে নির্ভয়ে এগিয়ে চলবেন।’’
কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘এই উপন্যাসে ব্যবহৃত ভাষা জীবন্ত। এভাবেই ওই অঞ্চলের মানুষ কথাবার্তা বলে। এখানে ব্যারেজটাই আসল। ব্যারেজে তিস্তার পানি বাড়া-কমা নিয়েই মানুষের সংকট।’
কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস বলেছেন, ‘‘হারুন পাশা-র ‘তিস্তা’ উপন্যাসে নতুন একটা ধরন আছে, বিচিত্র একটা গড়ন আছে। পাশা নবীন উপন্যাসকার, কিন্তু উপন্যাসটিতে দক্ষ রূপকারের চারিত্র্য ছড়িয়ে আছে। এ যেন তিস্তাপাড়ের কবিতা। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় ‘তিস্তা’র সবচাইতে বড় শক্তিটা কোথায়? আমি বলব, এর ভাষা, এর আঞ্চলিক ভাষাই উপন্যাসটির মূলধন। আর প্রতিটি চরিত্র বিপুল বৈচিত্র্যে মোহনীয়। উপন্যাসটির আরেকটি গুণ এর বাস্তবতা। তিস্তানদী, এর দুপাশে ছড়িয়ে থাকা মানবজমিন এই উপন্যাসের প্রধান অনুষঙ্গ। কথাগুলো শুধু লেখার জন্য লিখলাম না। উপন্যাসটির বৃত্তান্তে আমার কথাগুলোর সমর্থন আছে। ‘তিস্তা’ পাঠকনন্দিত হবে, অবশ্যই।’’
‘তিস্তা’ উপন্যাস সম্পর্কে এর লেখক হারুন পাশা বলেন, ‘‘তিস্তাপাড়ের ছেলে হিসেবে আমার একটা দায়িত্ববোধ আছে। সেটা কেমন, আমি ছোটবেলায় যে তিস্তাকে দেখেছি পানিতে ভরা, বড়বেলায় দেখি সেখানে পানি নেই। নিজের ভেতর ব্যথা-বেদনা কাজ করে। লিখি উপন্যাসটি। এ উপন্যাসে প্রাকরণিক নিরীক্ষাও করেছি। নিরীক্ষাটা হলো, এ উপন্যাসে চরিত্ররাই বলেছে তাদের কথা। লেখক হিসেবে কাহিনিতে আমার প্রবেশ নেই। বাংলা উপন্যাস-রীতিতে লেখকরাই বর্ণনা করেন উপন্যাস, মাঝে মধ্যে থাকে চরিত্রের সংলাপ। ‘তিস্তা’য় লেখকের বর্ণনা নেই, চরিত্ররাই নিজেদের যাপিত জীবনের ব্যাখ্যাকারক। তারাই বর্ণনা করে নিজেদের জীবনাভিজ্ঞতা ও সংকট; পাঠককে টেনে নিয়ে যায় উপন্যাসের প্রান্তে। বাংলা উপন্যাস-বর্ণনায় যে প্রচলিত রীতি রয়েছে তা ‘তিস্তা’য় নেই। ফলে বাংলা উপন্যাসে দেড়শত বছর ধরে প্রচলিত যে রীতি সেই রীতি ভেঙেছি ‘তিস্তা’ উপন্যাসে। এ নিরীক্ষা কিংবা রীতির সঙ্গেও পাঠক পরিচিত হোক।’’
তিস্তা
লেখক: হারুন পাশা
প্রকাশক: অনিন্দ্য প্রকাশ
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ।
মূল্য: ২৫০ টাকা।