পদ্মা-মেঘনা-যমুনার গর্ভে জন্ম নেওয়া স্রোতদের বয়ে আনা পলিমাটিতে গড়া এই দেশের আদিমানবেরা কেমন ছিল, তার খুব বেশি একটা জানি না। তবে তাদের বর্তমান উত্তরসূরিদের দেখে এই জনগোষ্ঠীর স্বভাব, আচরণ ও জীবনাচার সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা পাওয়া যায়। এক সময়ের গতিশীল পদ্মা, মেঘনা বা যমুনা এখন গতি হারিয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অশীতিপরায়ণ বৃদ্ধা হয়ে গেছে বটে, তবে তাদের সন্তানেরা ছুটে চলেছে খামখেয়ালিপূর্ণ গতিতে। উদাসীন ঢেউয়ে ভাঙছে কামারের প্রেমে গড়া সোনালি পট আর হারিয়ে যাচ্ছে তাতে আঁকা আমাদের সংস্কৃতি।
এদেশের মাটি যেন বড়ু চণ্ডীদাসের সৃষ্টি পৌরাণিক চরিত্র কৃষ্ণ, রাধা বা বড়ায়িদের চরিত্রের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভের রাধা বা গোপীদের মতো এই দেশের মাটিও বড্ড কামুক। পার্থক্য এই যে, চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভের মাটিতে রাধা বা গোপীরা কামুক ছিলেন কৃষ্ণপ্রেমে আর এই সময়ের মানবসন্তানেরা কামুক আধুনিকতার প্রেমে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বা শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভে বাসুদেব সদ্যভূমিষ্ঠ পুত্র সন্তানকে বৃন্দাবনের নন্দ গোপের ঘরে রেখে আসেন। আমরাও এক অর্থে বাসুদেবের পদানুসারী। আমরাও আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে রেখে এসেছি সুদূর ইংরেজ শিক্ষার প্রজারূপ শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থার কাছে৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বা শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভের রাধার মতো আমাদের ভাগ্যেরও সমর্পণ হয়েছে কোনো এক ক্লীব সত্তার কাছে। আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের জৈবিক আচরণ। দিন দিন হয়ে উঠছি ক্লীব, নপুংসক। আপন ঐতিহ্যকে ধুলোয় লুটিয়ে যে অন্য ‘দেবতা’র চরণ ধোয়া পানি পান করে, সে নপুংসক নয় তো কী! পুরো বাংলাদেশটাই আজ কেরেশী মাগন ঠাকুরের ‘পদ্মাবতী’র হীরামণিদের দখলে। সবাই কেবল চিতোরের পরমাসুন্দরী পদ্মাবতীরূপ আপন ঐতিহ্যের সঙ্গে কুটিল ও উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত রসালাপে ব্যস্ত৷ সিংহল রাজা গান্ধর্ব সেন হীরামণিবধের আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ব-দ্বীপে গন্ধর্ব সেন কে হবেন? সবাইই তো আজ হীরামণির রসালাপে মোহিত। শিল্প সমালোচকরা পদ্মাবতীকে লেখকের মস্তিষ্কপ্রসূত শিল্প বলেছেন যার বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে চলার পক্ষে তেমন কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু এদেশীয় কেরেশীদের দ্বারা রচিত পদ্মাবতী শুধু বাস্তবিকই নয়, অখণ্ডনযোগ্যও বটে।
গারো পাহাড়ের পাদদেশস্থিত নেত্রকোণার কথাই ধরা যাক। বিস্তৃত এই অঞ্চলের সরেস ও উর্বর মাটি লক্ষ মানিকদের কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। এই অঞ্চল থেকেই একটা সময় অবিভক্ত বাংলার মসনদে নলিনীরঞ্জনের মতো লোকেরা রাজত্ব করেছেন। কবিদের কবি নির্মলেন্দু গুণ এই নেত্রকোণার সন্তান। হেলাল হাফিজ থেকে শুরু করে হুমায়ুন আহমেদ, যার কথাই বলা যাক, এই অঞ্চলের বাইরের নন৷ দ্বিজ কানাইয়ের মহুয়া, চন্দ্রাবতীর মলুয়া, চন্দ্রাবতী-জয়চন্দ্রের নয়ানচাঁদ, দ্বিজ ঈশানের কমলা, চন্দ্রাবতীর দস্যু কেনারামের চন্দ্রাবতী, মনসুর বয়াতির দেওয়ানা মদিনা, কবি কঙ্কের বিদ্যাসুন্দর, চন্দ্রাবতীর রামায়ণ, দামোদর-রঘুসুত-নয়ানচাঁদ-শ্রীনাথ বেনিয়ার কঙ্ক ও লীলা বা অজ্ঞাত লেখকের রূপবতী, কাজল রেখা, দেওয়ান ভাবনাসমূহের সূতিকাগার এই বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল। আমরা এসবের কতদূর মনে রাখতে পেরেছি? খোদ নেত্রকোণা জেলারই শিক্ষার্থীরা এসব শিল্পকর্মের নাম শুনে ভ্রূ কুঁচকান। এসবকে আপন সম্পদ মানতে তাদের মুখে স্বভাবপ্রসূত অনিচ্ছা বা অস্বস্তি ফুটে ওঠে। কিন্তু কেন?
আমার জানামতে এই অঞ্চলের বহু প্রাচীন ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নজরদারি ও সচেতনতার অভাবে বিলীন হয়ে গেছে। একমাত্র সুসং সুর্গাপুরের রাজবাড়িটিই তার ব্যতিক্রম। সুসং দুর্গাপুরের সোমেশ্বর পাঠকের বংশধরদের তৈরি বাড়িটি ১৩০৬ বঙ্গাব্দে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। পাঠকের বংশধরেরা আবার বাড়িটি পুনঃনির্মাণ করেছিলেন। বাদবাকি স্থাপনা যেমন সুসলরাজ রঘুনাথ সিংহের মাধবপুর ছোট পাহাড়ের ওপর তৈরি করা শিবমন্দিরটি আজ বিলীন। মাঝে মাঝে মাটি খুঁড়ে দুই-একখানা ভগ্ন ইট পাওয়া যায়। কমলারাণী দিঘির একটি পাড় বাদে আর কোনো অস্তিত্ব নেই। সোমেশ্বর পাঠকের তৈরি দশভূজা মন্দিরও আজ ভূগর্ভে চাপা পড়েছে৷ পূর্বধলার ঘাগড়া, বাঘবেড় বা নারায়ণদহ জমিদার বাড়িগুলো বিলুপ্ত হয়েছে স্বাধীনতার আরও অনেক আগেই। ব্যতিক্রম কেবল মোঘল আমলের তৈরি সোনাইকান্দা, লেটিরকান্দা বা লালচাপুর গ্রামের মসজিদগুলো এখনো বার্ধক্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কাজেই পরিবর্তন নয়, এগোতে হবে বিপ্লবের পথে। এই বাংলায় আরও একটা লাল-সবুজের বিপ্লব হোক। মাথায় সুতি কাপড়ের লাল-সবুজ কাপড় বেঁধে আমাদের রাস্তায় নামতে হবে
নেত্রকোণার মানুষদের ইতিহাসকাতরতা বা ঐতিহ্যপ্রীতির অভাব সম্পর্কে ছোট একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। এই শহরটির বেড়ে ওঠা মগড়ার কোলে। মাতৃরূপ মগড়াকে সন্তানসম নেত্রকোণাবাসীরা কিছুই উপহার দিতে পারেনি বরং কেড়ে নিয়েছে যৌবন, ছিনিয়ে নিয়েছে গতিময়তা। এখানে ওখানে খোঁড়াখুঁড়ি আর ভরাট করে মায়ের দুধের দাম দিয়েছে শামুকগুঁড়োর দরে। যে মগড়ায় আগে মিনিট পাঁচেকের ভেতর ডজনখানেক লঞ্চ ছুটতো, সে মগড়ায়ই আজ মাঝারি আকারের ডিঙ্গিও মাঝনদীতে লুকায়িত চরায় আটকে পড়ে। নিজের বুক চিড়ে জেগে সেই চরগুলোকে দেখে শ্লথ ও মৃতপ্রায় মগড়ার অশ্রুপাত হয়। মগড়াদের কান্নার আওয়াজ সভ্য ও শহুরে নাগরিকজীবনের কোলাহলে হারিয়ে যায়, অনুরণন বা অনুনাদের সৃষ্টি করে না। হাওরভিত্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রক্রিয়া বা রীতিসিদ্ধ আচার আচরণগুলো আজ সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের স্মৃতিপট থেকেই মুছে যাওয়ার পথে-তাদের বিপরীতে এখন প্রভাব হাওয়াই মিঠাই আর রঙিন ম্যাগনেটের ফেরিওয়ালাদের।
প্রতিনিয়তই পাঠক হারাচ্ছে বাংলা সাহিত্য। তবে কি সাহিত্যিকরা আদতে সাহিত্যচর্চা করছেন না? না, অনেকেই করছেন এবং পাঠকসমাদৃতও হচ্ছেন। কিন্তু বেশিরভাগই পারছেন না। এর প্রধান কারণ পাঠকদের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে না পারা। সম্প্রতি বইমেলার আগে ও পরে বই নিয়ে যে হারে বিজ্ঞাপন লক্ষ করা যায়, তাতে বইকে পণ্য বলে গণ্য করাটা সাধারণ পাঠকের অপরাধ নয়। প্রকাশক বা অনলাইন বাজারিদের মাথায় রাখা উচিত, বই কোনো পণ্য নয়। বই হচ্ছে শব্দবন্দি হাজারখানেক আবেগের রূপ। কাজেই এটা ভাবা ঠিক নয়—বিজ্ঞাপন প্রচার করে পাঠকের লাইব্রেরি বা বুকশেলফে জায়গা করে নেওয়া যাবে। আজকাল লেখকরা পাণ্ডুলিপির মাহাত্ম্যে বই প্রকাশ করার ঝামেলা পোহান না, হাজার বিশেক টাকা ঢাললেই গোটা শ চারেক বই ছাপা হয়ে যায়। ঢাকার বইমেলা ঘুরে বাদবাকি কপি প্রকাশকেরা ‘সযত্নে’ লেখকদের বস্তাবন্দি করে পাঠিয়ে দেন। তাই আজকাল আর সাহিত্যিক দেখি না—গুটিকয়েক ফেসবুকীয় ঋতুভিত্তিক কবি আর সুযোগসন্ধানী প্রকাশকদের খপ্পরে পড়া ‘প্রকাশে ইচ্ছুক’ লেখক দেখি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের এই খরা কি ছিল? আজকের তরুণরা ভাতকে রাইস, মাছকে ফিস, মুরগিকে চিকেন, খাসিকে মাটন আর গরুকে বিফ বলে। আজকাল মফস্বলের বিয়েবাড়িগুলোতেও হাতে মেখে খাবার খাওয়াটা অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ে। পহেলা বৈশাখ বা পহেলা ফাল্গুন বাদে ধুতি পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় বের হলে লোকের আক্কেলগুড়ুম চোখ দেখে গয়ানাথের সন্দেশের কথা মাথায় ভাসে। কখনো কি আমাদের জাতিগত এই হীনম্মন্যতার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি? বাঙালি জাতি নালন্দা ছেড়ে আজ কেন অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজের দুয়ারে উপস্থিত হয়? ভেবে দেখেছি কি খাদি-নকশি কাঁথা বা হাতের কাজ করা চাদর-মাফলারের মতো জিনিসগুলো কেন হারিয়ে যাচ্ছে? কেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক তাঁতপল্লী?
এই বাঙালি জাতিই একটা সময় নিজেদের মাতৃভাষার স্বার্থ রক্ষার্থে বুকে পাথর চেপে রাজপথে নেমেছে। আইয়ুব-ইয়াহিয়াকে খাটিয়ায় তুলেই থেমে যায়নি, এরশাদ-মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনকেও পরাস্ত করেছে। একাত্তরে প্রেমিকার ভালোবাসাকে ছুটিতে পাঠিয়ে প্রেমের স্বর্গ থেকে ধরণীর বুকে নেমে এসেছে অস্ত্র হাতে। নিজের মায়ের কোল থেকে নেমে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলকে মাতৃজ্ঞান করেছে। নিজের রক্তে ভাসিয়েছে আস্ত একটা ব-দ্বীপ৷ তবে আজ কেন এই অপারগতা? আকাশবাসী স্যাটেলাইট আর তাদের মর্ত্যের এজেন্ট স্যাটেলাইট বাজারিদের দৌরাত্ম্যে পড়ে কেন আজ বাউল-জারি-সারি পশ্চাপদতার উদাহরণ? আজকাল কত উদ্যোগই তো নেওয়া হচ্ছে। উলালা আর ইয়ো ইয়ো সংস্কৃতিটা আমাদের নয়—এই ধারণাটুকু এই প্রজন্মের স্বাপ্নিকদের স্বপ্নে বপন করার উদ্যোগটুকুও দ্রুত নিতে হবে। নইলে সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন লাল-সবুজের পতাকাটিও আর আমাদের থাকবে না।
পরিবর্তন একটি সাময়িক প্রক্রিয়া. যার শুরু ও শেষ আজ ও আগামীকালের মাঝে। কাজেই পরিবর্তন নয়, এগোতে হবে বিপ্লবের পথে। এই বাংলায় আরও একটা লাল-সবুজের বিপ্লব হোক। মাথায় সুতি কাপড়ের লাল-সবুজ কাপড় বেঁধে আমাদের রাস্তায় নামতে হবে। হাতে থাকবে চকচকে গিটারের বদলে একখানা ভাঙা একতারা। আর মুখে হিন্দি বা পশ্চিমা বুলিতে অবাঙাল ঢঙের সঙ্গীতের বদলে মহুলা-মলুয়ার পাট। তবেই হবে সময়ের সাধন, বাংলার মাটি হয়তো কাঁদবে আবার। এ কান্না দুঃখ বা অপমানের নয়, এ কান্না মর্যাদা ফিরে পাওয়ার আনন্দের।