‘পাঠকের পাতা’র এবারের আলোচনার বই ছিল নূরজাহান বোসের ‘আগুনমুখার মেয়ে’। গত ২৮ জুলাই বইটি নিয়ে নিউইয়র্কের কুইন্স লাইব্রেরির বাংলা বুক ক্লাবে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে মূল আলোচক ছিলেন সাংবাদিক, লেখক মনজুর আহমদ, অনুপস্থিত থাকলেও লিখিত বক্তব্য প্রেরণ করেন লেখক পূরবী বসু। এটি অনুষ্ঠানে পাঠ করেন কাজী জহিরুল ইসলাম। অন্যান্যের মধ্যে আলোচনা করেন আহমাদ মাযহার, আবদুল্লাহ জাহিদ, মুক্তি জহির, ওবায়েদুল্লাহ মামুন, সৈয়দ ফজলুর রহমান, ফারহানা আজিম শিউলি, লেখক-কন্যা মনিকা জাহান বোস এবং কাজী জহিরুল ইসলাম।
এবারের আসরের বাড়তি আকর্ষণ ছিল লেখক নুরজাহান বোসের উপস্থিতি। তিনি বলেন, সবাই বলে আমি অনেক সাহসিকতার সঙ্গে নারীদের সমস্যাগুলো তুলে এনেছি। কিন্তু সব কথা আমি বলতে পারিনি। আমি যা লিখেছি, প্রকৃত সমস্যা এর চেয়েও ভয়াবহ। সমস্যা শুধু বাংলাদেশে নয়, সবখানেই। কোলকাতায় দেখেছি, এমনকী এই খোদ আমেরিকায়ও। বাচ্চা পালন করা ছাড়া মেয়েদের আর কোনো পরিচয় নেই। আর মেয়েরা ঘরে-বাইরে, সবখানে পুরুষদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে, আত্মীয়, অনাত্মীয়, চেনা-অচেনা নানান পুরুষের দ্বারা। আমি বলবো, সব বলবো, আরও একটি বই লিখবো, সেখানে সব কথা লিখবো। মনজুর আহমদ বলেন, বইটি আমি অনেকদিন আগে পড়েছি, পঞ্চাশের দশকের বাংলাদেশকে পাওয়া যায় এই গ্রন্থে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা বানে ভেসে যাওয়া এবং সেই ভেসে যাওয়া মানুষকে আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ তারা এটিকে জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবেই মেনে নিয়েছে। এমনি অসংখ্য ঘটনা নুরজাহান বোস তুলে এনেছেন তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে।
কাজী জহিরুল ইসলাম বলেন, সবাই বলছেন মেয়ে লেখকেরা সাহসিকতার সঙ্গে অনেক কথা বলতে পারেন না, নূরজাহান বোস সেই কাজটি করেছেন। আমি বলি, পুরুষ লেখকদেরই বা সেই সাহস কোথায়? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাংলাদেশের লেখকদের সত্য বলার সাহস খুব কম। আগুনমুখার মেয়ে গ্রন্থটি অনেক সত্য অকপটে প্রকাশ করেছে। আমি এই গ্রন্থটিকে একটি মাস্টারপিস গ্রন্থ বলতে চাই দুটি কারণে, একদিকে যেমন লেখক তাঁর নিজের জীবনের কথা সেন্সর না করে তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে তার ভাষা সেই কাটাখালির চরের কাদার মতো নরম এবং খাঁটি, যা এই গ্রন্থটির সাহিত্যমূল্য অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
লাইব্রেরি ম্যানেজার আবদুল্লাহ জাহিদ বলেন, আমি এই বইটি পড়েছি এবং এটি নিয়ে লিখেছিও। আমার কাছে এটি একটি অনবদ্য গ্রন্থ মনে হয়েছে। মুক্তি জহির বলেন, মেয়েদের সমস্যাগুলো একজন নারী লেখক যেভাবে বুঝবেন পুরুষ লেখক সেভাবে বুঝবেন না। আমি সেই দক্ষিণাঞ্চলের মেয়ে, বইটি পড়তে পড়তে সেই অঞ্চলের নারীদের করুণ জীবন কাহিনী চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। নূরজাহান বোস সেই জীবন থেকে উঠে আসা মানুষ। অন্য নারীদের সঙ্গে তার পার্থক্য হলো, অন্যেরা সেই জীবন যাপন করেছেন, আর তিনি তার যাপনকে নিজের মতো করে তৈরি করে নিয়েছেন। সেই যাপনকেই জীবন করে তুলেছেন এবং এই গ্রন্থে তা জীবন্ত করে তুলেছেন।
আহমাদ মাযহার বলেন, অনেক কথাই বলা হয়ে গেছে, আমি একটি দিক হাইলাইট করতে চাই, প্রাপ্তির আশায় বা হারানোর ভয়ে আমাদের লেখকেরা অনেক কথাই বলতে চান না বা বলতে পারেন না, নূরজাহান বোস এইসবের ঊর্ধ্বে উঠে লিখেছেন। আনন্দবাজার সংস্করণটি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে, ঢাকার সংস্করণে ব্যক্তি পরিচয়ের একটি তালিকা যোগ করতে পারলে গ্রন্থটি আরও সমৃদ্ধ হতো।