কেউই দশক-শতক হিসাব করে কবিতা লেখে না। বাল্মিকীর মতো আকস্মিক কোনো ঘটনায় অনুরণিত হয়ে লিখে ফেলে তার প্রথম কবিতা। মনের এই আকস্মিক অনুভূতি কাউকে মুখে বলে বোঝানো যায় না, আমাদের আটপৌরে ভাষায় ঠিক ধরানো যায় না মনের বিশ্বস্ত রঙও। তাই লিখে ফেলতেই হয়। লেখার পর প্রতিটি কবির মাঝেই বাল্মিকী পুনর্বার জন্ম নেয়; জন্ম নিয়ে বিস্ময় বিহ্বলভাবে বলে এ আমি কী বললাম! কারও সেই বিহ্বলভাব কেটে যায় সঙ্গে সঙ্গেই। কেউ কেউ শব্দের রঙে, ধ্বনিতে, ঝঙ্কারে মুগ্ধ হয়ে রচনা করে যান একের পর এক কবিতা। সেই কবিতা একসময় প্রকাশিত হয়ে পৌঁছে যায় পাঠকের হাতে। কবির এই আবির্ভাবের সময় হিসাব করে কেউ কেউ বলেন, অমুক দশকের কবি। সময়ের হিসাব রাখা ছাড়া দশকের আর কোনো গুরুত্ব নেই কারও কাছেই। লিখতে লিখতে যখন একজন কবি তার স্বর, স্বতন্ত্র অবস্থান নির্মাণ করতে পারেন, তখনই তাকে পাঠক গ্রহণ করে, দশকের গজফিতা কখনো তাকে পৌঁছাতে পারে না পাঠকের দোরগোড়ায়। আমরা যদি নব্বই দশকের দিকে তাকাই, নব্বই দশকে আবির্ভূত অসংখ্য কবিদের নাম আজ আর চোখে ঠেকবে না। প্রায় দুই দশকেই কারও কারও পথের দম পথেই ফুরিয়ে গেছে, কেউ ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেছেন প্যাভিলিয়নে, কেউ কেউ গোলক ধাঁধায় পড়ে নিজেকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। সময়ের কুটিল ভ্রƒকুটি উপেক্ষা করে যাঁদের নাম কীর্তির বিভায় আলোকিত হয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে, ওবায়েদ আকাশ (জ. ১৩ জুন, ১৯৭৩) তাদের একজন।
স্কুলে পড়ার সময় কবিতার সঙ্গে সখ্য কবি ওবায়েদ আকাশের। ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে চলে আসেন রাজবাড়ী ছেড়ে রাজধানীতে, ঢাকায়। জীবন-জীবিকার কঠিন সংগ্রামের সময় ওবায়েদ আকাশের সঙ্গে কবিতার সঙ্গে সখ্য গড়ায় প্রণয়, না বলা ভালো পরিণয়ে। কবিতার সাথেই এখন তার ঘর-গেরেস্থালি।
আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, ‘শিল্পীকে মূল কেন্দ্রে থাকতে হয়।’ একটি দেশের মূলকেন্দ্র নিঃসন্দেহে তার রাজধানী। ওবায়েদ আকাশও রয়ে গেছেন এই রাজধানীতে, মহানগরীতে। কিন্তু বিস্মৃত হননি তাঁর ফেলে আসা দিন, তাঁর গ্রাম, তাঁর হিরণ¥য় শৈশবকে—
ফসল কাটাও শেষ হলো আর শুরু হলো
দূরদূরান্ত বহু দেশ থেকে আসা পাখিদের সভা
ফের নাচতে নাচতে ফসল কাটার আনন্দ উদযাপন করছি
আর শিশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে জড়িয়ে ধরছি
সদ্য কাটা মুথামাঠভর্তি এইসব নিত্যনতুন পাখিদের আনাগোনা দেখে
পাশ থেকে ডেকে আনি ছোট্টবেলার খেলার সাথীদের
(অনর্থ লেখা)
যদিও,
‘রূপনগর আমার হাত থেকে একদিন কেড়ে নিয়ে গেছে চালতার ব্যাগ। আমার
প্রিয় চালতাফুল, যাকে বড় হতে দিয়ে একদিন ছ’টাকায় উঠে পড়ি এই নগরের
ট্রেনে; (রূপনগর)
এই নগরীর কোলাহল, আলোকসজ্জা, ঝাকঝমকে কবি তার গ্রামকে ভুলে যাননি। ভুলে যাননি তার সজল শৈশবকে। মূলত কোনো কবিই ভুলতে পারেন না তার ফেলে আসা দিন, তার শৈশবে। সব কবিই উত্তর জীবনে বিনির্মাণ করেন তার মধুমাখা ছেলেবেলাকে। ওবায়েদ আকাশ ব্যতিক্রম নন তার থেকে। ওবায়েদ আকাশের কবিতার একটি বিরাট অংশ সৃষ্টি হয়েছে গ্রাম বাংলার প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। রূপসী বাংলার বিশালত্ব তিনি ধরতে চেয়েছেন কবিতার মোহনীয় ক্যানভাসে। শুধু কাব্যিক অনুষঙ্গ হিসেবে নয়, ওবায়েদ আকাশ গ্রামবাংলাকে তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন একটি দায়বদ্ধতা থেকে। তাছাড়া আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একজন কবি যত ভালোভাবে তাঁর স্বদেশকে চিনবেন, জানবেন, স্বদেশের মৃত্তিকায় তাঁর শিকড় যত গভীরে প্রোথিত করে দিতে পারবেন, তিনি তত বেশি মনে-মননে বিশ্বনাগরিক হবেন। একুশ শতকের ্এই নগরায়ণের যুগেও শ্যামল গ্রামই বাংলার প্রাণকেন্দ্র, নিউক্লিয়াস। গায়ের জোরে গাঁকে ভুলে থাকা যেতে পারে, কিন্তু গ্রামের গুরুত্বকে কখনওই অস্বীকার করা যাবে না। কবি ওবায়েদ আকাশ বলেন, ‘রামায়ণ কিংবা মহাভারতের চেয়ে বড় মহাকাব্যের ভূমি আমার গ্রাম। আমার গ্রামের প্রতিটি ধূলিকণা আমি পাঠ করেছি; আমার গ্রামের প্রতিটি বৃক্ষের প্রতিটি পাতার বিকাশ ও ঝরে পড়া আমি পাঠ করেছি। আমার গ্রামের ওজন এই পৃথিবীর অবশিষ্ট জল-স্থলের চেয়ে অনেক বেশি। মানুষ বিশ্বভ্রমণ করে, গাড়ি-বাড়ি করে, পদ-পদবির অধিকারী হয়ে, ক্ষমতাবান হয়ে, সুপার স্টার হয়ে আনন্দ পায়। আর আমি আমার গ্রামে ফিরে যেতে পারলে আনন্দ পাই।…আমি কবিতায় যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার গ্রামকে উন্মোচন করতে পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।…তাই গ্রামীণ অনুষঙ্গ আমার কবিতার অন্যতম সৌন্দর্য। আমি মনে করি আমার কবিতায় আমার গ্রামের প্রতিনিধিত্ব থাকলে, আমার কবিতায় আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। আর আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব থাকলে আমার কবিতা একদিন সারাবিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করবে।’
তাই মানুষকে তার স্বরূপ জানার জন্যে গ্রামে ফিরে যেতেই হবে, ফিরে যেতে হবে শেকড়ের টানে—
স্কুল পালানোর মতো দুর্ভাগ্য তোমার হয়েছে
এখন মদের গ্লাস মুখে তুমি বেরিয়ে পড়েছ
. জঙ্গলে, পিচঢালা রাতের রাস্তায়মাঝখানে দীর্ঘকাল হলো—ভুলে গেছ
গাছভর্তি কুল পেকে নুয়ে-নেমে এলে
ছুটিছাটায় ফিরে যেতে গ্রামের বাড়িতে
… … … …
এইবার মদের গ্লাস নামিয়ে রেখে
তুমি তাদের চিনে নিতে
. অঝর ধারায় ছেড়ে দিচ্ছ দেহে
(গণতন্ত্রের নুন)
গ্রাম বিচিত্ররূপে উঠে এসেছে ওবায়েদ আকাশের কবিতায়। কখনো নৃতাত্ত্বিক গুরুত্ব নিয়ে, কখনো সৌন্দর্যের আধার হিসেবে, কখনো প্রিয়ার রূপের উপমা প্রতীক হিসেবে। তিনি যখন লিখেন—
তুমিও নদীর মতো বদলে যেতে পারো
উদর স্ফীত করে ফেটে যেতে পারো
. ক্রন্দসী ব্যাঙের মতো
(তুমি যা যা পারো)
অথবা,
বহুবিধ ফুলের ঐশ্বর্য নিয়ে তুমি ফুটে আছ বাগানে বাগানে। দীর্ঘ দূরত্বে বসে যা
আমার কাছে কেবলই কাঁটাঝোপময়। সান্ধ্য আর ভোরের বাতাসে আমি নীল
ঘুড়ি নিয়ে ঘর ছেড়ে বহুদূর আসি, প্রবাহিত বাতাসের ইশতেহার হতে শুঁকে
দেখি ফুলেদের বর্ণিল ঘ্রাণ।
(ফুলজন্ম, মানুষজন্ম)
তখন নতুন করে নেই প্রকৃতির পাঠ, তখন মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
আধুনিক কবিতার কপাল থেকে দুর্বোধ্যতার তিলক কিছুতেই মুছে ফেলা যায় না। এর দুটি কারণ আছে বলে মনে হয়। এক. কবি যখন নিজেই বুঝতে পারেন না তিনি কী চাইছেন, কিভাবে চাইছেন সৃজনকর্ম সম্পন্ন করতে? দুই. কবির প্রজ্ঞা, বোধ-বোধি যখন পাঠকের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, কবির সমপরিমাণ প্রস্তুতি থাকে না কাব্যভাষাকে বোঝার জন্য। তবে, হ্যাঁ, উৎকৃষ্ট কবিতা আমরা তাকেই বলবো, যা পাঠের সময় পাঠকের অনির্বচনীয় আনন্দের আবির ছড়িয়ে দেয়। পাঠক হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে কবিতার অর্থ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়, বা কখনো কখনো একটি কবিতার সম্পূর্ণ অর্থ পাঠকের কাছে অধরা থাকতেই পারে কিন্তু পঠনের সময় কবিতার শব্দযোজনা, ঝঙ্কার, মাধুর্য,খণ্ডিত অর্থ পাঠককে বিমোহিত করে, পাঠান্তে কবিতার এক বা একাধিক পঙ্ক্তি মনের মাঝে গুঞ্জরণ তোলে, পাঠক কখনো কখনো কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের অজান্তে বলে ওঠেন কবিতার কয়েকটি শব্দ, কয়েকটি লাইন। ওবায়েদ আকাশের তেমন একটি কবিতা আমরা সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করবো, টানাগদ্যে লেখা যে কবিতাটি আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় শেষতক। প্রথম প্রাঠের অর্থের সঙ্গে কিছুটা ব্যবধান থাকে পুনঃপাঠের অর্থ। মূলত এখানেই পাঠকের লাভ—পাঠের আনন্দ, অর্থের ব্যঞ্জনা তাকে পুনঃপুনঃ সমৃদ্ধ করে।
কবিতাটি হলো—
এক কৃষকের মেয়ে-কিশোরী সে-স্কুলে যায়- লোকজন বলে-প্রতিটি সকালে- না যদি সূর্য ওঠে- একমুঠো কাঠের আগুনে- পৃথিবী কি আলোকিত হয়? প্রতিবেশী আমি- এমনই কিশোরী সে- রাত করে ছড়া-পদ্য লেখে- কেবলই আমাকে চেনে- আর ভাবে মনে মনে- একদিন তুমিও কিশোর- প্রেমপদ্য লিখে
শেষে-ছুড়েছো আগুনে- আমি তার পদ্য ঘেঁটে পাই- রূপের আগুনে তার- পতঙ্গেরা পুড়ে পুড়ে- কত হলো ছাই- আরো লেখে মেয়ে- অন্যত্র তুষের আগুন- কৃষক পিতাকে তার- আজন্ম জ্বালিয়েছে- তারো চে’ দ্বিগুণ- আমি তাকে বলি- রূপের সীমানা যদি- খেয়ে যায় ঘুণে-ছড়া-পদ্য লিখে মেয়ে- তুমিও ছুড়বে আগুনে- আমার রচনাবলি- চারিদিকে বারুদের ঘ্রাণে-একদিন জেনো তারা-গড়াবে ধুলায়-আর তুমি কৃষককন্যা-একমুঠো কাঠের আগুন-প্রতিদিন দেখা হবে- তারায় তারায়।
(কৃষককন্যার কাব্যচর্চা)
একজন কবি যদি একই বিন্দুতে স্থির থেকে তাঁর শিল্পকীর্তি স্ফীত করতে থাকে, তাহলে তা একঘেয়ে হতো বাধ্য। অন্যভাবে বলা যায়, একজন শক্তিশালী কবি বা মেজর পয়েটকে চিহ্নিত করতে হলে তাঁর কাব্যের বিষয়-বৈচিত্র্য, ভাষা, আঙ্গিক, ক্রম-অগ্রসরতা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। আমাদের দেখতে হবে ওবায়েদ আকাশ তাঁর কাব্যভূমণ্ডলে কতটুকু, তা প্রয়োগ করতে পেরেছেন। প্রথমে বলা ভালো, কবিতা নির্মাণে ওবায়েদ আকাশ স্বতন্ত্র কাব্যস্বর তৈরি করেছেন ইতোমধ্যে। শব্দবয়ন, অবয়ব গঠন, করণকৌশলে ওবায়েদ আকাশকে সহজেই শণাক্ত করা যায়। কাব্য নিরীক্ষা হিসেবে তিনি বিরাম চিহ্নের লোপ ঘটিয়েছেন কবিতার সমাপ্তি থেকে। আরও কিছু কিছু পরীক্ষা তার কবিতায় আছে পরিলক্ষিত হয়। কালের প্রাচীর ডিঙিয়ে তা কতটুকু সফলতা পাবে তার ভার কালের ওপর-ই ন্যস্ত থাক। আমরা তাঁর কাব্যসিদ্ধির নির্ণায়ক তার ভাষাভঙ্গির একটি নমুনা তুলে ধরছি—
বারান্দায় সিঁদ কেটে চুরি হয়ে গেছে আমার প্রিয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ
গল্পের বইটি। তাতে আমার কোনো হাত নেই। কেননা, এ বইয়ের একটি
গল্পও যখন পড়া ছিল না, তখন একদিন হারানের নাতজামাই ছোটবকুলপুরের
যাত্রীদের কাছে নিয়ে এসেছিল কতগুলো উলঙ্গ টিকটিকির ছানা।
(মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প)
‘স্বতন্ত্র ৬০টি কবিতা’ কাব্যগ্রন্থে ওবায়েদ আকাশ যে ভাষার পত্তন ঘটালেন, তার সার্থক প্রয়োগ ঘটান কাব্যগ্রন্থ ‘প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায়’। ওবায়েদ আকাশের কবিতা কখনো ছন্দে সমর্পিত, কখনো টানা গদ্যের প্রসারিত অবয়বে আবদ্ধ। তিনি আকৃতিতে নাতিদীর্ঘ কবিতায় যেমন নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন, তেমনি রচনা করেন দীর্ঘাকৃতির কবিতাও। ‘বিবিধ রঙের মাছরাঙা’ চারফর্মার এই বই তাঁর একটি কবিতার সংকলন। ব্যষ্টিক দুঃখ যেমন তাঁর কবিতায় অনুরণন তোলে, তেমনি সামষ্টিক যন্ত্রণা, তৃতীয় বিশ্বের দুঃখ চিৎকৃত হয় তাঁর কাব্যে। তাঁর ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ কাব্যগ্রন্থে তৃতীয় বিশ্বের মানুষের দুর্দশার চিত্র বর্ণিত হয়েছে।
ওবায়েদ আকাশ প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি। প্রকৃতি তাঁর কাছে এক রহস্যের আধার। সবুজবৃক্ষ তার কাছে সংকেতময়, প্রাণস্পন্দনময়। প্রকৃতির মতো আধুনিক জীবনের গভীর থেকে গভীর অসুখকে শুশ্রূষা দেয়, আলোকিত করে ওবায়েদ আকাশের কবিতা।