কবি কাজী জহিরুল ইসলাম রচিত ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ ‘শেকড়ের খোঁজ’-এর ওপর অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো একটি প্রাজ্ঞ আলোচনা অনুষ্ঠান। কুইন্স লাইব্রেরির বাংলা বুক ক্লাব পাঠকের পাতা ২১ এপ্রিল এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে গ্রন্থটির ওপর লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. বিলকিস রহমান দোলা। মুক্ত আলোচনা করেন ড. মাহবুব হাসান, ওবায়েদুল্লাহ মামুন, অধ্যাপক আখতার হোসেন, আবদুল্লাহ জাহিদ, মিজানুর রহমান জোদ্দার, ফরহাদ ইসলাম, সৈয়দ ফজলুর রহমান, রাজিয়া নাজমী প্রমূখ।
লিখিত প্রবন্ধে ড. বিলকিস রহমান দোলা বলেন, আমি বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়াতাম, তখন এ রকম একটি বইয়ের খুব প্রয়োজন ছিল। যে তথ্যগুলো আমরা বিভিন্ন বই থেকে নিয়ে ছাত্রদের কাছে তুলে ধরতাম, তার প্রায় সবই এই গ্রন্থে আছে। লেখকের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, তিনি খুব সহজ করে ইতিহাসের কঠিন ও জটিল অধ্যায়গুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। তবে এই গ্রন্থটি পড়তে গিয়ে আরও অনেক কিছু জানার তৃষ্ণা তৈরি হয়। আমি প্রত্যাশা করছি, পরের সংস্করণে তিনি বাংলার শাসন ব্যবস্থার ইতিহাস আরও বিস্তৃত করবেন। তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা উপকৃত হবে। বাংলা ভাষার জন্ম ও এর বিকাশ একটি গল্পপ্রবাহের মধ্য দিয়ে তিনি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। কিভাবে সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে চর্যাপদ থেকে আজকের বাংলা ভাষা তৈরি হয়েছে, তা তিনি ধারাবাহিকভাবে উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
ড. মাহবুব হাসান বলেন, এটি খুব পরিশ্রমসাধ্য কাজ। এই কাজের জন্য কবি কাজী জহিরুল ইসলামকে সাধুবাদ জানাই। তবে ড. দোলার মতো আমিও মনে করি, এর কলেবর আরও বড় হওয়া উচিত ছিল। ১৪৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থ আমার তৃষ্ণা মেটাতে পারেনি।
আলোচকদের সমালোচনা করে অধ্যাপক আখতার হোসেন বলেন, আমি অবাক হচ্ছি এজন্য যে, এই গ্রন্থে যা নেই, তা নিয়ে আলোচকেরা আক্ষেপ করছেন। কিন্তু এই গ্রন্থে যা আছে, তা নিয়েই আলোচনাটি করার কথা ছিল। বইটিতে প্রচুর তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। এসব তথ্যে যদি কোনো অসঙ্গতি থাকে, সেটা নিয়ে বরং সমালোচনা করা যেতে পারে।
ওবায়েদুল্লাহ মামুন বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বাঙালির সংগ্রাম ও স্বাধীনতাকে তুলে এনেছেন লেখক, এটি প্রশংসার দাবি রাখে। একইসঙ্গে তিনি মতাত্মা গান্ধীর জীবনপ্রবাহের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাস। তিনি সমালোচনা করে বলেন, লেখক মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে ১১টি সেক্টর এবং এর কমান্ডারদের কথা বলেছেন কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার সম্পর্কে কিছুই বলেননি।
বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষা পরিবারের বংশলতিকা বিশ্লেষণ করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন ফরহাদ ইসলাম। তিনি বলেন, বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে আসেনি।
আবদুল্লাহ জাহিদ বলেন, আমার কাছে ‘শেকড়ের খোঁজ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বই বলে মনে হয়েছে। আমি মনে করি, এই বইটি সবার পড়া উচিত। তিনি এই জমজমাট বই আলোচনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে কুইন্স লাইব্রেরির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান।
সৈয়দ ফজলুর রহমান বলেন, আমি মনে করি লেখক উপস্থিত থাকলে তাঁকে আগে কথা বলতে দেওয়া উচিত। বইটি সম্পর্কে লেখকের কাছ থেকে আগে-ভাগে জেনে নিতে পারলে আলোচকদের সুবিধা হয়।
লেখক কাজী জহিরুল ইসলাম তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, পরের সংস্করণে পরিমার্জন করা হবে। তিনি আরও বলেন, আমি এর কলেবর খুব বড় করতে চাইনি। ভাষাটি সহজ করতে চেয়েছি, যেন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা সহজে বইটি পড়ে বুঝতে পারে। চেয়েছি বাংলা ভাষার উৎপত্তি এবং এর বিকাশের ইতিহাস তারা জানুক, পাশাপাশি চেষ্টা করেছি একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলই ডিসেম্বর এবং পহেলা বৈশাখ এই চারটি জাতীয় দিবস কী এবং কেন, তা বিশদভাবে তুলে ধরতে।
এবারের অনুষ্ঠানে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে বাংলা বর্ষবরণ। এতে ছিল নানান স্বাদের পিঠার সমাহার, বৈশাখী গান ও কবিতা পাঠ। সঙ্গীতে অংশ নেন শারমীন মোহসীন, সূতপা মণ্ডল, ভায়লা সালিনা লিজা, মুক্তি জহির, কনিকা, রুমা দিলরুবা প্রমূখ। কবিতা আবৃত্তি করেন নজরুল কবীর, মোহাম্মদ মোহসীন, মিজানুর রহমান জোদ্দার ও রাজিয়া নাজমী।
উল্লেখ্য, কুইন্স লাইব্রেরির পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা বুক ক্লাব গড়ে ওঠে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রতি মাসে কর্তৃপক্ষ একটি গুরুত্বপূর্ণ বাংলা বই নির্বাচন করেন, সদস্যরা বইটি লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করে সারা মাস পাঠ করেন এবং মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে একত্রিত হয়ে বইটি নিয়ে আলোচনা করেন। মে মাসের জন্য নির্ধারিত হয়েছে হাসনাত আবদুল হাই রচিত ‘নভেরা’ উপন্যাস। ‘নভেরা’ নিয়ে আগামী ১২ মে শনিবার কুইন্স লাইব্রেরির হলিস শাখায় আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।