সম্প্রতি ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা সংস্থা সূচীপত্রের স্বত্বাধিকারী সাঈদ বারী ‘নবীন ও তরুণ লেখকদের প্রতি’ শীর্ষক একটি পোস্ট দিয়েছেন তার ফেসবুক টাইম লাইনে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘পাণ্ডুলিপি তৈরি করেই বই প্রকাশের জন্যে ব্যস্ত হইয়েন না! পাণ্ডুলিপিটা দুই/এক বছর ফেলে রাখুন। তারপর নিজেই ধরতে পারবেন, আপনার লেখায় কোথায় কোথায় দুর্বলতা! অভিজ্ঞ কাউকে দেখান। সম্ভব হলে পেশাদার পাণ্ডুলিপি-সম্পাদককে দিয়ে সম্পাদনা করিয়ে নিন। (এখন এরকম অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে)। এরপর না হয় প্রকাশকের হাতে দিন। তাহলেই সম্ভব মানসম্মত বই প্রকাশনা।’
সাঈদ বারীর এই পোস্টটি চিন্তাসূত্রের টাইমলাইনে উল্লেখ করে পাঠক-লেখকদের কাছ থেকে অভিমত আহ্বান করা হয়। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে, প্রথমে দীর্ঘ মন্তব্য করেন, আজাদ মণ্ডল (Azad Monda)। তিনি বলেন, ”প্রথমে, সূচিপত্রের স্বত্বাধিকারী জনাব সাঈদ বারীকে ধন্যবাদ জানাই। নবীন ও তরুণ লেখকদের প্রতি তার পরামর্শ অত্যন্ত কার্যকর-গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যের যেকোনো শাখা (কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প প্রভৃতি) বই আকারে প্রকাশের আগে লেখককে অবশ্যই সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। মোটকথা ভাস্কর যেমন সম্পূর্ণ একটা কাঠের গুঁড়িকে যত্নের সঙ্গে আস্তে আস্তে খোদাই করে শেষে একটি সুন্দর ভাস্কর্য তৈরি করতে সক্ষম হন, ঠিক তেমনি লেখককেও বই প্রকাশের আগে যত্নবান হতে হয়। আর এই জন্য প্রয়োজন সময়। কোনো কিছু লিখে তাড়াহুড়ো না করে সেটাকে সময় নিয়ে বারবার পড়া, বানান শুদ্ধ করা, অপ্রাসঙ্গিক অংশ বাদ দেওয়া, প্রাসঙ্গিক বিষয় সংযোজন করা অর্থাৎ বারবার এডিটিং করা সাহিত্য সাধনার একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। উত্তম সাহিত্যের জন্য বহুবার এডিটিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে সময় কেবল দুই একবছর নয় তারও বেশি লাগতে পারে। বিশ্বখ্যাত আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তার যে বইটির জন্য ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেই ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ বইটি সম্পর্কে কথিত আছে, তিনি মোট একাশিবার এডিট করেছিলেন। প্রমথনাথ বিশীর ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ বইটিও তিনি বারবার এডিট করেছিলেন। সাঈদ বারী সাহেবের স্ট্যাটাসটি নবীন ও তরুণ লেখকদের জন্য শুধু যুক্তিযুক্ত নয়, অবশ্যই পালনীয় বলে আমি মনে করি।”
এরপরের কমেন্টটি এস এম মনিরের। তিনি লিখেছেন, ”লেখলের রাজ্যে জন্মগ্রহণ করে নিজেকে ধন্য মনে করছি, যেখানে অগণিত লেখক কিন্তু পাঠক শূন্য।
কবিতা,
আমি গেলুম মামা বাড়ি,
মামা দিয়াছে কিনে ঝাল-মুরি।
খাইলাম বসে টুনা-টুনি,
তাইনা দেখে হাত তালি বনমালি।
দারুন ছন্দের মিল!
তবে আমি কি কবি না?
অবশ্যই! আপনার কবিতা খুব সুন্দর, আমি আপনার কবিতা পাঠে মুগ্ধ হলাম প্রিয় কবি।
আমি কি একটা বই প্রকাশ করতে পারি?
নিশ্চয়ই, আপনার নোবেল না পাওয়া পর্যন্ত আমি আছি।
তবে প্রকাশ করুন একটা বই, টাকা যা লাগবে আমি দেবো। বই প্রকাশিত হলো বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক এসএম মনিরের মহাকাব্য গ্রন্থ, ‘বউ ক্যনো চলে যায়’। কিন্তু পাঠক পেলাম না।একজন পাঠক কিনেছিলেন, ফেরতও দিয়ে গেছেন। এই হলো আমাদের মহাকবি ও লেখক। সাহিত্য নিয়ে খেলবেন না। লেখক হতে চাইলে পাঠক হওয়া প্রয়োজন।”
এরপর কমেন্ট করেছেন জগবন্ধু হালদার (Jagabandhu Halder)। তার মতে, যেকোনো সৃষ্টির শক্ত ভিত গঠন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ। সাহিত্যের ভিত গঠনের অন্যতম শর্ত ব্যাপক পড়াশোনার মাধ্যমে ভাষার শুদ্ধতা, শব্দের সঠিক প্রয়োগরীতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। কবিতা লিখতে হলে কেবল আবেগনির্ভর হলে চলবে না, ছন্দের জ্ঞান, উপমা, উৎপ্রেক্ষা সৃষ্টিতে পারদর্শিতা, শব্দের সঠিক চাল সম্পর্কে জানতে হবে। ছোটগল্প বা উপন্যাস লিখতে হলে ভাষা ও শব্দের প্রয়োগরীতির সঙ্গে থাকতে হবে গভীর জীবনবোধ, ব্যাপক অভিজ্ঞতা, স্থান কাল পাত্র, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানার্জন। এসব ছাড়া সাহিত্য রচনা করলেও তা মানসম্পন্ন হওয়া নিয়ে সন্দেহ থাকবেই। গভীর শিল্পবোধ, পড়াশোনার ব্যাপকতা ব্যতীত মানসম্মত সাহিত্য রচনা অসম্ভব। ”
এই রিপোর্ট লেখাপর্যন্ত (মঙ্গলবার দিবাগত রাত তিনটা) সর্বশেষ কমেন্ট করেছেন কবি চাণক্য বাড়ৈ। তার মতে, ”আসলে কমিটমেন্টটাই জরুরি। একজন তরুণের যেমন কমিটমেন্ট থাকতে হবে, তেমনি প্রকাশকেরও। কিছু একটা দিলেই প্রকাশক সেটিকে মলাটবদ্ধ করবেন না, এই কমিটমেন্ট যখন প্রকাশকদের মধ্যে প্রবল হবে, তখনই একজন লেখক ছাইপাশ লিখেই প্রকাশকের কাছে ছুটে যাওয়ার সাহস পাবে না।”
সাঈদ বারীকে তার ফেসবুক পোস্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি চিন্তাসূত্রকে বলেন, ‘প্রথমত, তরুণ ও নবীন লেখকরা ভালো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই বই ছাপাতে প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠায়। দ্বিতীয়ত, পাণ্ডুলিপি তৈরি করতেও অধিকাংশ লেখক জানেন না বা পারেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে লেখাপড়ার মান অনেক কমে গেছে।’ এর একটা প্রভাব লেখকদের মধ্যে পড়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।