কবিতা-১
বিরান শস্যক্ষেত, খরায় পোড়ে মাটির শরীর
গোয়ালে বলদ বাঁধা, কাঁতরায় কৃষকের চোখ;
এখনি বৃষ্টি নামুক, আলপথে জলের নহর
বৃষ্টি চাই, কাঁদে মানুষ, বিদীর্ণ ফসলের বুক।
আবার কখনো-সখনো ভেসে যায় জলের ভেলা
একাকার গ্রাম, গঞ্জ, লোকালয়, নিকানো উঠোন;
বানভাসি মানুষ জানে প্রকৃতির দারুণ খেলা
জীবন মৃত্যুরে নিয়ে প্রতিদিন কৃষক সন্তান।
আমিতো নিজেকে চিনি—কতটা কোমল পেলবতা
মিশে আছে মৃত্তিকায়, জীবন-জগৎ সংসারে,
নতুন প্রজন্ম জানে আমার স্বপ্নের বৃক্ষলতা—
প্রিয়াংকা জল দাও, জীবনের গহন শেকড়ে।
কুটিল সময়ের ফাঁদে নবীন অনার্য সন্তান,
যুদ্ধ নয়, আরাধ্য সুন্দর চাই সমগ্র জীবন।
কবিতা-২
ঝড় জলে ভিজে আমার খুব জ্বর হয়েছিল
কী নিদারুণ মাদকতায় ভরে ওঠে শরীর
চোখের আলোতে ভেসে থাকে স্বপ্নের নেশা—
হৃদয়নাথ,
মর্মের গভীরে সুবিশাল চাদর মেলে ধরে
আমাদের অতীত থেকে উঠে আসে হেলেনিক ফসিল,
আমাদের বর্তমান থেকে উঠে আসে ব্যালেস্টিক মহড়া,
আমাদের আগামীর জন্য ধরে রাখি হাফিজের গজল।
রাতদিন থাকে জ্বর
জ্বরের কুলঙ্গি-খোপে থাকে ভালোবাসা
প্রত্যাশায় রোগহীন সজীব জীবন।
কবিতা-৩
এ কোন আবক্ষমূর্তি—কৃষ্ণ পাখি-নগরে বাউল—
প্রতি দিনমান স্থির হয়ে থাকে অলীক স্টেশনে;
যেন নিদ্রামগ্ন বিজ্ঞ যাদুকর বুলায় আঙুল,
এভাবে ভাসতে থাকে প্রাণপাখি—স্বপ্নের সাম্পানে
অনাদিকালের হাওয়ায় ভাসে নর্ম সহচরী
স্বপ্ন জাগরণে তীব্র খেলা থাক মৃত্যুর বিবরে,
চৈতন্যের গভীরে প্রিয়াঙ্কার মগ্ন লুকোচুরি
ভালোবাসা ধেয়ে যায় কল্লোলিত অসীম সাগরে।
আলিফ লায়লা রাত থেকে এই নিয়নসাইন
সহস্র সময় মিশে আছে বেদনার ইতিহাসে;
মানুষ জেনেছে শুধু ছলনার সুতীব্র দহন
তবু জানি শরমিন্দাময় একজন ভালোবাসে।
একাকার মিশে যাক দু’জনার যাবতীয় ভুল
স্বপ্নের শহর হতে তুলে নেবো মানবিক ফুল।
কবিতা-৪
অতীত ঐতিহ্য আছে আর আছে মানুষে বিশ্বাস—
দীপ্র পেশী জানে—যেভাবে গড়েছে গৌরিক-মৃত্তিকা
পদ্মার জলেতে আছে কৃষকের স্বপ্ন-পুত্তলিকা,
আমার রক্তের মাঝে থাক এর অনন্ত উচ্ছ্বাস!
বাতাসে মিলায়ে গেছে আমাদের কতো দিনরাত?
পাথর সময় থেকে চলমান কালের হাওয়া
এ কোন মানুষ আমি ভুলে যাই পিতৃমন্ত্র-কায়া,
তবু রাখি স্বপ্নময় সুবর্ণ আমার দাওয়াত।
পথ চিনি আর চিনি জীবনের আদম সুরত;
কোথা আমাজান কূল, আর প্রমত্তা পদ্মার জল;
একাকার মিশায়ে দিয়েছে নতুন প্রজন্ম দল—
উজান স্রোতের টানে ভেসে যায় প্রেমিক মরদ।
আমি কি তোমার নই? ক্রুশবিদ্ধ প্রেমের মদন
এই হাত বাড়িয়ে দিলাম অদম বঙ্গ লালন।
কবিতা-৫
মুখর জংশন কেঁপে উঠে, ওভারব্রিজে তুমি নেই—
মুহূর্তেই ছোপ ছোপ শোক জমে থাকে।
জনাকীর্ণ রেলিং, রঙ-বেরঙের মানুষের মুখ
তেপ্পান্নটি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে থাকে মনবলাকা
ব্রিটিশীয় স্মৃতি চিহ্ন লৌহবীম মাড়াতে মাড়াতে উঠে যাই
হৃদয়নাথ ফিরেনি—
শিরিষের পাতায় হাওয়া নেই
মধ্য দুপুরে আকাশের কাছে উড়ে চিল
স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে ক্রাসে ভর দেয়া বিষণ্ন যুবক;
মনে হয় একাত্তরে হৃদয়নাথ যুদ্ধ থেকে ফেরে
হৃদয়নাথ, যুদ্ধ থেকে ফেরে
হৃদয়নাথ, ক্ষত নিয়ে ফেরে
হৃদয়নাথ, মিছিল নিয়ে ফেরে
হৃদয়নাথ, ভালোবাসার কাছে ফিরে নাই।
কবিতা-৬
ভয়ার্ত শহরে ওরা ফিরে আসে পতাকা উড়িয়ে
নিমিষে উজাড় স্ট্রীট ভরে যায় উদ্বেল মানুষ—
চমৎকার বাতাসে উড়ে ছবি, রঙিন ফানুস;
সহস্র কণ্ঠস্বর মিলিয়ে যায় আকাশ পেরিয়ে।
মীরপুর বধ্যভূমি থেকে ডাকে শহীদ করোটি
রক্তগঙ্গায় ভাসছে যে শহর, কিম্ভূত দেবদূত
যেন বেয়নেট উত্তেলিত অযুত হৃদয়নাথ
একদিন এইভাবে জন্ম নেয় প্রেমের ভ্রূকুটি।
সোনালী বিশ্বাস বুকে লক্ষ্যভেদী কালের অর্জুন,
যেভাবে ফিরেছে ঘরে স্বপ্নভূক যতটুকু প্রেম—
তোমাকে দিলাম সখি স্বদেশের নিকষিত হেম,
প্রাপ্যটুকু চাই, বুকে বাহুলতা—হাতে স্টেনগান।
আগামী ভুবনে তুমি আর আছে অথই নীলিমা—
তুমি হাত দাও, আমি তুলে দেব ভোরের সুষমা।
কবিতা-৭
পুরোনো শিলালিপির দুটো বয়ান তোমাকে শুনিয়ে নেই—
প্রথম শিলালিপি
জাতি: অনার্য
ধর্ম: মানবতা
ইতিহাস: হাজার বছর
বর্তমান: একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা
আগামী: স্মৃতি-বণিক
পাত্র-পাত্রী: হৃদয়নাথ-প্রিয়াঙ্কা।
দ্বিতীয় শিলালিপি
মধ্যবিত্ত জীবন
কবিতা-৮
সহস্র যোজন দূর—
শতাব্দীর গায় হরিৎ বসন-ফলবান পুষ্প শাখা—
আকস্মিক আকাশ থেকে গোত্তা মেরে ‘স্যাবর’ নামে
মৌন মুগ্ধ সন্ধ্যার মনুমেন্টে প্রিয়াঙ্কা দাঁড়িয়ে—
প্রতীক্ষাকাতর সাধারণ তরুণী
বিশ শতকের মেয়ে।
চোখের কার্নিশ জুড়ে ফুলেল উদ্যান,
অভিমানী কৈশোর, স্থবির বর্তমান,
আর রোরুদ্ধ শঙ্কাতুর ভালোবাসার লোকালয়
জুড়ে অনন্ত নীল দিনরাত।
অনেক কাল পর
হৃদয়নাথ লিখে, প্রণয়ের কৃষ্ণ-কাজল পরিহিত
তরুণ; প্রতিপ্রহর একটি শান্ত বিকেল বেলার প্রতীক্ষা
করে বর্ণাঢ্য বাসনায়। আদমের কষ্টের পাঁজরে যে
রমণী—তা ছিলো রূপকথা।
কবিতা-৯
কারো কারো গভীর গোপন কষ্ট থাকে অন্যলোকে,
যেন অসহায় মনুমেন্ট, ক্লান্ত মুগ্ধ সন্ধেবেলা
পার্কের নির্জন অন্ধকারে খুঁজে ফেরে তারাজ্বলা
শহর। রঙিন স্বপ্ন সাধ জাগে মায়াবী পুলকে।
কাকে জাগায়ে রাত্রির রহস্য রেনুতে সাঁতরায়;
মনুষ্য জীবন বাঁধা থাক রূপান্তরে, পৃথিবীর
জাগতিক, প্রাকৃতিক প্রয়োজন এই মানুষের—
প্রিয়াঙ্কা রমনীয় বাসনার স্বাদ পেয়ে যায়।
নিতান্ত সহজবদ্ধ নারী, উষ্ণ পাললিক তনু—
যতটুকু মসৃন মৃত্তিকা তার চেয়ে মমতায়
কষ্টেরে জাগায়। অলৌকিক রাত যায় দিন যায়,
ক্রমাগত নিজেতে জড়ায় ভালোবাসা পরমাণু।
তুমি কি বর্ষার নদী? বহমান উজাড় যমুনা
শেকড়ের কাছে ঋণী শেকড়েরই মৃত্যু আলপনা।