প্রতিটি চলচ্চিত্রেরই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। সব চলচ্চিত্রই বিনোদন দেওয়ার জন্য নির্মিত হয়। তবে কিছু চলচ্চিত্র থাকে, যেগুলো বিনোদনকে ছাড়িয়ে অন্য কোনো প্রতীকে রূপ নেয়। এই চলচ্চিত্রগুলোর বেশিরভাগই কালে কালে মানুষেরা মনে রাখে। এগুলো শুধু বিনোদন দেয় না, মানুষের মনকে ছুঁয়ে যায়, মানুষের অনুভূতিকে স্পর্শ করে তীব্রভাবে। এমনই একটি চলচ্চিত্র ‘থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড অ্যাবিং, মিসৌরি’। ২০১৭ সালের অন্যতম আলোচিত এই চলচ্চিত্রটির পর্দা ওঠে গত সেপ্টেম্বরে। চলচ্চিত্রটি বোদ্ধা মহলে আলোচিত হওয়ার একটি প্রধান কারণ, এর বিষয়বস্তু ও গল্প। গল্পটি আসলে আশা-নিরাশার গল্প। আবার পরিবর্তন ও জেগে ওঠার আহ্বান মিশ্রিতও।
মনে করুন, আপনার মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে কেউ। আপনি তার মমতাময়ী মা। অনেক সময় পার হয়ে গেলেও অপরাধীরা ধরা পড়েনি। আপনি এখন কী করবেন? কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবেন? না কি তিনটি পরিত্যক্ত বিলবোর্ড ভাড়া করে সেঁটে দেবেন তিনটি বাক্য, ‘ধর্ষণরত অবস্থায় মারা গিয়েছিল’, ‘এবং এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি?’, ‘কী কারণে, চিফ উইলবি?’
আপনি যাই করুন না কেন, এই তবে মিল্ডরেড হায়েস তার কন্যা এঞ্জেলাকে ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের আশায় দ্বিতীয় কাজটিই করেছিলেন। যার কাছে মিল্ডরেডের অভিযোগ, তিনি কমিউনিটির একজন খ্যাতিমান পুলিশ অফিসার, উইলবি। কমিউনিটির সব মানুষের ভালোবাসা আছে উইলবির সঙ্গে। ডেন্টিস্ট থেকে শুরু করে চার্চের ফাদারও তার ভক্ত। তার সুনাম বনাম মিল্ডরেডের বিলবোর্ডের যুদ্ধ ক্রমেই জমে ওঠতে থাকে সিনেমাটির প্রথমভাগে। ক্যান্সার আক্রান্ত উইলবির জীবনের অবসান হলে ঘটতে থাকে আরও ঘটনা।
চলচ্চিত্রটির প্রথম থেকেই একা একা সংগ্রাম করেন দৃঢ়চেতা নারী মিল্ডরেড। এ সংগ্রামে তিনি সঙ্গে পাননি তার ছেলে কিংবা তার এক্স-হাজবেন্ডকে। তাকে সহযোগিতা করতে তেমন কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। বরং বার বার বাধার সম্মুখীন হয়েছেন মিল্ডরেড। বাধার সম্মুখীন হয়েও দমে যাননি মিল্ডরেড হায়েস, শিরদাঁড়া উঁচু করে তার সমুচিত জবাব দিয়েছেন। তবে শেষমেশ অফিসার জেসন ডিকসন নাটকীয়ভাবে তার সমব্যথী হন, যোগ দেন তার সংগ্রামে।
দুঃখ, হতাশা, অসহায়ত্ব, ক্ষোভ, জীবনবোধ সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়েছে থ্রি বিলবোর্ডসে। আমেরিকার একটি বিশেষ অঞ্চলের কমিউনিটি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার কিছু বৈশিষ্ট্য সফলভাবে ফুটে উঠেছে সিনেমাটিতে। এছাড়া তিনটি বিলবোর্ডের কথা না বললেই নয়। সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিলবোর্ড তিনটি নিয়ে নানা কথা হয়েছে। একসময় মনে হয়েছে বিলবোর্ড তিনটি ধর্ষণের বিরুদ্ধে দৃঢ় উচ্চারণ, আবার কখনো মনে হয়েছে বিলবোর্ড তিনটিই বোধহয় উইলবির আত্মহত্যার কারণ। মিল্ডরেডের কাছে বিলবোর্ড তিনটি হয়ে ওঠে তার মেয়ের মতোই কিংবা তার দুঃসহ দুঃখ মোচনের আশার দিশারী।
তবে চলচ্চিত্রটির গ্রন্থিমোচনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন উইলবি। বিশেষ করে তার আত্মহত্যা ও মৃত্যুর পূর্বে তার লেখা দুটি চিঠি চলচ্চিত্রের গ্রন্থিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। সিনেমাটির সমাপ্তির প্রবাহ আসলে টেনেছে উইলবিই।
সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন উঠতি আইরিশ পরিচালক মার্টিন ম্যাকডোনাগ। ২০১২ সালে ম্যাকডোনাগ নির্মিত সেভেন সাইকোপ্যাথস দর্শক আলোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও থ্রি বিলবোর্ডসে তিনি অন্যরকম প্রতিভার প্রদর্শন করেছেন। থ্রি বিলবোর্ডসের চিত্রনাট্যও তার লেখা। চরিত্র সৃষ্টি ও তাদের ভেতর জটিল সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন তিনি চিত্রনাট্যে। আবেগপ্রবণ ডিকসনে মনের আকস্মিক পরিবর্তন ঘটিয়ে ম্যাকডোনাগ নির্দেশ করেছেন মানুষ পরিবর্তনশীল প্রবণতা। মানব জীবনের পরিবর্তনের পেছনে নিয়ামক হতে পারে জীবনের একটি মাত্র ঘটনা, পরিবর্তনের জন্য রাশি রাশি ঘটনাপ্রবাহের প্রয়োজন পড়ে না।
সিনেমাটির মিউজিক প্রথম থেকে শেষ অবধি শ্রুতিমধুর লাগবে সবার কাছেই। কার্টার বারওয়েল এক্ষেত্রে তার কাজটি ভালো মতোই সেরেছেন। অভিনয়ের কথা বলতে গেলে সব চরিত্রই স্ব স্ব জায়গায় ভালো অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে ফ্রানসেজ ম্যাকডরম্যান্ডের কথা বলতেই হবে। কী তার ব্যক্তিত্ব? কী তার অভিব্যক্তি? একজন সংগ্রামী নারী চরিত্র মিল্ডরেডকে প্রস্ফুটিত করতে তিনি তার সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন। সম্ভবত এটাই ম্যাকডরম্যান্ডের সেরা অভিনয়। চলচ্চিত্রটির প্রতিটি ক্ষণে তার মুখাবয়ব একদিকে যেমনি দুঃখ ভারাক্রান্ত, তেমনি প্রতিবাদী। উডি হ্যারেলসন উইলবি চরিত্রকে করেছেন বিশেষায়িত। স্যাম রকওয়েল ডিকসন চরিত্রে যুক্ত করেছেন অভিনব মাত্রা। একদম দুই মেজাজের একই চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে তার কোনো সমস্যাই হয়নি। বরং দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রের মানসিক পরিবর্তনকে বাহ্যিক পরিবর্তনের মাধ্যমেও প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যে ম্যাকডরম্যান্ড ও রকওয়েল গোল্ডেন গ্লোবের দৌড়ে জিতে নিয়েছেন সেরা অভিনয়ের পুরস্কার, কোনো ব্যত্যয় না হলে অস্কারও ঢুকবে তাদের ঘরে।
থ্রি বিলবোর্ডসকে সময়ের কষ্টিপাথরে পরিমাপের সময় এখনো হয়নি। তবে হলিউড চলচ্চিত্রে ধর্ষণের বিরুদ্ধে এমন শক্ত উচ্চারণ শৈল্পিকভাবে ও আবেগপ্রবণভাবে উঠে এসেছে খুব কম। ঘটনাপ্রবাহের চমক, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব, দারুণ অভিনয়ের সম্ভার ও সম্প্রতি হলিউডে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত বিষয়াদির ফলেই গোল্ডেন গ্লোব পেয়েছে এ বছরের অন্যতম আলোচিত সিনেমা থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড অ্যাবিং, মিসৌরি। শুধু গোল্ডেন গ্লোব কেন, স্রোত যেদিকে প্রবাহিত হচ্ছে, মার্চের অস্কারেও পেয়ে যেতে পারে থ্রি বিলবোর্ডস।