পাঠকপ্রিয়তা ও জনপ্রিয়তা এক নয়। তবে, পৃথিবীর কোনো কোনো কবি একইসঙ্গে জনপ্রিয় ও পাঠকপ্রিয় হয়েছেন। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ কাজ করেছে। সে প্রসঙ্গ থাক। প্রসঙ্গ কবিতা হলে জনপ্রিয়তার প্রশ্নটি নেহায়েতই অমূলক। রাজনৈতিক ব্যত্যয় ছাড়া খুব কম কবির ভাগ্যে জনপ্রিয়তা জোটে। কবিতার ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা নয়, পাঠকপ্রিয়তা বিবেচ্য হওয়া উচিত।
বাংলা কবিতায় কালজয়ী কবিদের সবার প্রিয়তা বা পাঠকপ্রিয়তা যে মরণোত্তর, তা কিন্তু নয়। যে জীবনানন্দকে এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করানো হয়, তিনিও জীবদ্দশায় বোদ্ধা বা দীক্ষিত পাঠকসমাজের নজর কেড়েছিলেন। পাশ্চাত্যে বোদলেয়ার, ইয়েটস, অ্যাপলিনের, পাউন্ড, এলিয়টসহ অনেক কবির নাম করা যায়, যারা বেঁচে থাকতেই পাঠকপ্রিয় ছিলেন। আবার, প্রত্যেকেই কবিতায় নতুন বাঁকের স্রষ্টা। কালজয়ী রুশকবি পুশকিনও সমকালেই পাঠকপ্রিয় ছিলেন।
বাংলা কবিতায়, নিকট অতীতে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও শামসুর রাহমান এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। নতুনত্বের প্রশ্নে একজন পদ্যের ছদ্মাবরণে লিরিকের বিনির্মাণকারী, অন্যজন অক্ষবৃত্তের স্বনির্মিত প্রবহমানতায় বাংলা ও বাঙালির প্রতিইতিহাসবেত্তা। ভবিষ্যতে শঙ্খ ঘোষ ও আল মাহমুদের কবিতার ক্ষেত্রেও পাঠকপ্রসাদ অপেক্ষা করছে বলে ধারণা করা যায়। কথা এই যে, কবির কাছে একজন জননেতার জনপ্রিয়তা আশা করাটা নিছকই বোকামি। এমনকি ঔপন্যাসিকের পাঠকপ্রিয়তাও আশা করতে নেই।
কবিতা চিরকালই সংখ্যালঘু পাঠকের সম্পত্তি। কালজয়ী কবিরাও একটি নির্দিষ্ট পাঠকবলয়ে বেঁচে থাকেন; এই একুশ শতকেও কবিকঙ্কন মুকুন্দরামকে তারা চেনেন। অন্যদিকে, মুকুন্দরামের সমসাময়িক সম্রাট আকবরের নাম শোনেননি, এমন মানুষ গোটা উপমহাদেশেই কম পাওয়া যাবে। এত যে পাঠকপ্রিয় ওমর খৈয়াম বা জালালুদ্দিন রুমি, তারাও সিজার বা আলেকজান্ডারের মতো পরিচিত নন। ধর্মপ্রবর্তকদের মতো জনপ্রিয় হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
কবিতায় বলেছি, ‘লঘুমেঘে বৃষ্টি হলে কবিতার বাড়াভাতে ছাই’। নিবিড়পাঠকালেও কথাটি মান্যতা পায়। তাই, কবির জনপ্রিয়তা নিয়ে কেউ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে বিরক্ত হই। বিষয়টি অবান্তর। যারা উত্থাপন করেন বা এ নিয়ে মাথা ঘামান, ধরে নেওয়া যায়, স্বভাষা-বিভাষার কবিতার ইতিহাস সম্পর্কে তাদের ধারণা মোটেও স্বচ্ছ নয়।