১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ডিসি কমিকসের নাম শোনেনি এমন চলচ্চিত্রবোদ্ধা কমই আছে। সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, গ্রিন ল্যানটার্ন, দ্য ফ্ল্যাশ, অ্যাকুয়াম্যান, ব্লাক ক্যানারি, হকম্যান, সুপারগার্ল, হকগার্ল, গ্রিন অ্যারো, মারশিয়ান ম্যানহান্টার, সাইব্রগ, স্ট্যাটিক, জাটানা, শাজাম—এসব চরিত্র সৃষ্টিতেই হাত আছে ডিসি কমিকসের। ডিসি কমিকসের মাধ্যমে ১৯৪১ সালে উইলিয়াম মোলটন মার্সটন যে অতি মানবীয় কাল্পনিক চরিত্রটির সঙ্গে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেটিই হলো ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’।
নতুন আমাজন রাজকুমারী সুপার হিরোইনের ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরি। বেশ কিছু অতি-মানবীয় শক্তি জন্মগতভাবে তার মধ্যে রয়েছে। সুপারম্যান যেখানে ভিন্নগ্রহের বাসিন্দা, সেখানে এই নতুন সুপার হিরোইন ডায়ানা স্বয়ং জিউসের কন্যা। তাই এখন প্রশ্ন জাগবে, কে বেশি শক্তিশালী? সুপারম্যান না কি ওয়ান্ডার ওম্যান?
ওয়ান্ডার ওম্যান ডায়ানার ক্ষমতা ও ক্ষমতার উৎসগুলো:
→অতিমানবীয় শক্তিধর, গতিসম্পন্ন, নিরলস
→উড়তে সক্ষম
→হাত দিয়ে মারামারিতে পটু
→ল্যাসো দ্য ট্রুথ বা সত্যের দড়ি
→তরবারি
→ঢাল
→ব্রেসলেট
→বুমেরাং মুকুট
সিনেমাটি সুপার হিরোইন ধারার প্রথম সিনেমা না হলেও এটিই প্রথম সুপার হিউম্যান চলচ্চিত্র, যেটি পরিচালনা করেছেন একজন নারী, প্যাটি জেনকিন্স। শুধু পরিচালনাই করেননি, ১৯৪১ সালের ওয়ান্ডার ওম্যান চরিত্রকে একটি নতুন আধুনিক মাত্রায় উন্নীত করেছেন।
সিনেমাটির গল্প অন্য সব সুপার হিউম্যান সিনেমার মতো সাদা মাঠা নয়। এমনকি মার্সটনের গল্প থেকে একটু দূরে সরিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবহ যুক্ত করা হয়েছে। ওয়ান্ডার ওম্যান হওয়ার আগে ডায়ানা আমাজন নামক এক ভিন্ন ধরনের গোষ্ঠীর রাজকুমারী ছিল, যেখানে শুধু মেয়েরা বসবাস করে। তারা শত শত ভাষা বোঝে। জিউসপুত্র যুদ্ধের দেবতা অ্যারিসের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য তাদের নির্জন দ্বীপে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে। সেই দ্বীপে একটা যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে, সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া স্টিভ ট্রেভর তাদের বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের নির্মমতার কথা জানায়। এরপর ডায়ানা যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে একের পর এক বিশেষ ক্ষমতাগুলো দেখাতে থাকে।
অ্যালান হ্যানবার্গের চিত্রনাট্যে আছে যুদ্ধের নির্মমতা, আছে আমাজন কন্যা ও একজন বাস্তবতাবাদী গোয়েন্দার দৃঢ় উপস্থাপনা। একই সঙ্গে দুটি গল্প যেন পাশাপাশি সমান্তরালে অগ্রসর হয়েছে। একদিকে ওয়ান্ডার ওম্যান ডায়ানার অ্যারিসকে অন্বেষণ, অন্যদিকে স্টিভ ট্রেভরের লুডেনডর্ফকে অন্বেষণ সমান তালে সমান গতিতে একি সঙ্গে অগ্রসর হয়েছে। যদিও তারা একসময় বুঝতে পারে তাদের দুজনেরই যাত্রাপথ একই তবু তাদের ভেতর সূক্ষ্ণ বিভেদ থাকে। এই বিভেদই ওয়ান্ডার ওম্যানের গল্পে মাত্রা যুক্ত করেছে। নতুন সিনেমাটিতে মানুষ এবং দেবতার প্রেমের অন্যকথায় প্রেমের জয়গান গাওয়া হয়েছে। দেবতার সঙ্গে দেবতার যুদ্ধে, ভাইয়ের সঙ্গে বোনের যুদ্ধে জয় হয়েছে প্রেমের। অন্যদিকে সিনেমাটির শেষমুহূর্তের টুইস্টটি সুপারহিরো সিনেমার অন্যতম সেরা টুইস্ট।
অ্যাকশন দৃশ্যের কথা বলতে গেলে সাদামাটা কিন্তু দৃষ্টিনন্দন। অন্য সব সুপার হিরো সিনেমার মতো অ্যাকশন এতে নেই, তবে যেগুলো আছে সেগুলো খুব কৌশলী। সিজিআই গ্রাফিক্সের কাজ অনেকটা আধপোড়া রুটির মতো, তারপরও উপভোগ্য সেই রুটি। কাউকে উদ্ধার করার যে থ্রিল সাধারণত সুপার হিরো সিনেমাতে থাকে, এখানে সেই থ্রিল নেই। সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে শুধু একটাই শব্দ ‘অ্যারিস’।
রুপার্ট গ্রেগসন উইলিয়ামসের মিউজিক ও ম্যাথিউ জেনসেনের সিনেমাটোগ্রাফিতে ওয়ান্ডার ওম্যান নান্দনিকতা পেয়েছে। আর চিত্রনাট্য উপস্থাপনায় পরিচালক প্যাটি জেনকিন্স প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেন-নারীরাও পারে সুপার হিউম্যান ধারার সিনেমা তৈরি করতে। হয়তো তার পথ ধরে আরও নারী পরিচালককে এরকম সাহসী পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হবে। তিনি সূক্ষ্ণভাবে আমাজনের সমাজব্যবস্থা, যুদ্ধকালীন লন্ডনের অবস্থা ও যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা দেখিয়েছেন।
এতকিছুর পরেও কোনো সিনেমাই সফলতার মুখ দেখে না, যদি না অভিনেতারা তাদের দক্ষতার পরিচয় না দেন। এদিক দিয়ে ওয়ান্ডার ওম্যান চরিত্রে গাল গ্যাদোতের প্রশংসা না করে উপায় নেই। কোনো সুপার হিরোইন সিনেমাতে এরকম সংগ্রামী ও দৃঢ়চেতা নারী চরিত্র দেখা যায়নি। স্টিভ ট্রেভর চরিত্রে ক্রিস পাইন বোধহয় অভিনয়ে গাল গ্যাদোতকেও ছাড়িয়ে গেছেন। ক্রিস পাইন তার চরিত্র উপস্থাপনায় প্রেমাত্মক, সাহসী ও বুদ্ধিমান। অন্যদিকে জার্মান জেনারেল লুডেনডর্ফ চরিত্রটিতে ড্যানি হাডসনের দিকে দৃষ্টি বারবারই আটকে যাবে। আবার আপনি যখন গভীরভাবে ভাববেন, ডক্টর মারুর গুরুত্বও ফেলে দিতে পারবেন না। এটি এমন এক চরিত্র যে শারীরিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ, যে কিনা বিজ্ঞানের সাধক, লুডেনডর্ফের সঙ্গী। অথচ যখন তার আবিষ্কৃত গ্যাস দিয়ে অন্য জার্মান জেনারেলদের হত্যা করে লুডেনডর্ফ, তখন সে শঙ্কিত।
দুর্বল-সবল উভয় দিকই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বানানো সিনেমাটির বিদ্যমান। তবু একথা বলতেই হবে, সুপারহিরো প্রেমীদের জন্য ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’ আরেকটি নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছে যেখানে মানুষ ও দেবতার প্রেমের জয়গান গাওয়া হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে- সিনেমাটি ইতিহাসের নির্যাস সংবলিত, চমৎকার ও উপভোগ্য।