সময়টা খুব বেশি দিন আগের নয়। তখন টিভি চ্যানেল বলতেই বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বিটিভিকে বুঝতো। বিটিভির সামনেই সবাই বসে থাকত বিনোদন উপভোগ করার জন্য। তবে, তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এখন এদেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অভাব নেই। আর সময়ের পরিবর্তনে বিটিভির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ছোট শিশুদের প্রিয় মীনা চরিত্রটির মৃত্যু ঘটতে চলেছে। এদিকে কারও নজর নেই।
মীনা কার্টুন দেখেনি এ রকম মানুষ বাংলাদেশে কমই আছে। ১৯৯৩ সালে বিটিভির মাধ্যমে মীনা যাত্রা শুরু করে। মীনা চরিত্রটি সৃষ্টির আগে ব্যাপক গবেষণা করা হয়। অন্তুত ১০ হাজার শিশুর মত নেওয়া হয় মীনার কেমন পোশাক হবে কিংবা মীনার জীবন কেমন হবে, এই বিষয়ে। মীনা ১৯৯৩ সাল থেকে আজ অবধি দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভূটানের টিভি পর্দায় একটি প্রতিবাদী নারী চরিত্র। মীনা প্রতিবাদ করেছে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে, যৌতুকের বিরুদ্ধে, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে। মীনা কথা বলেছে নারী শিক্ষার পক্ষে, নারী-পুরুষের সম অধিকারের পক্ষে।
সম্প্রতি ২০১৭ সালের ১ মে ইউনিসেফ বাংলাদেশ তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে মীনার একটি নতুন পর্বের ভিডিও প্রকাশ করে। মে দিবসে এই পর্বটি প্রকাশ করার পিছনে কিছু কারণ আছে। পর্বটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আমরা খেলতে চাই’। আধুনিক চিন্তাভাবনার এই পর্বটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম বিষয়ক আইন এবং এর প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা মীনার এই পর্বের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। একটি হচ্ছে, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের অবশ্যই স্কুলে যেতে হবে এবং তাদের কলকারখানায় নিয়োগ নিষেধ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ১৪-১৮ বছর বয়সী শিশুরা দৈনিক ৫ ঘণ্টা ঝুঁকিপূর্ণ নয় এমন কাজ করতে পারবে কিন্তু এক্ষেত্রে কারখানার মালিকদের অবশ্যই শিশুদের বিনোদন এবং শিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে।
শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে অবস্থান বাদেও বাংলাদেশের শিশুদের ক্রিকেট উন্মাদনা, নদী ভাঙনের নির্মমতা এবং গ্রামের মানুষদের শহরমুখী হবার প্রবণতা এই পর্বে স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে। পর্বটিতে মীনা সরাসরি শিশুশ্রম বন্ধে ভূমিকা না রাখলেও স্বপ্নের মাধ্যমে এক অন্যরকম জগতের সৃষ্টি করা হয়েছে যেখানে মীনাকে দেখা যায় মহারাণী হিসেবে। রাজ্যের ক্রিকেটমন্ত্রী দীপুর কাছে মীনা জানতে পারে, ক্রিকেট খেলার জন্য কোন শিশু রাজ্যে নেই। সবাই কারখানায় কাজ করতে গেছে।
মহারাণী মিনার নির্দেশে রাজদূত মিঠু একে একে শিশু, কারখানা মালিক এবং অভিভাবকদের ডেকে আনে। মীনা তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করে সদ্যুত্তর পায় না। তাই রাজপণ্ডিত রাজুর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম আইনের বিষয়াদি সবাইকে বুঝিয়ে দেয়। শিশুরা খেলতে পারবে, পড়তে পারবে জেনে আনন্দিত হয়ে ওঠে।
অন্য পর্বগুলোর মতই এ পর্বে সাবলীল গ্রাফিক্সের ব্যবহার লক্ষণীয়। টুন বাংলার স্টুডিওতে করা মীনা কার্টুনের ‘আমরা খেলতে চাই’ পর্বটির এনিমেশন ডিরেক্টর মোহাম্মদ ইমাম হোসেন এবং রাম মোহনের গল্পের ওপর ভিত্তি করে চিত্রনাট্য লিখেছেন ডিপা বালসাভার।
বর্তমান অবস্থার পরিপেক্ষিতে এই পর্বটির গুরুত্ব অপরিসীম। ইউনিসেফের জুন ২০১০ সালের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের ৫-১৪ বছর বয়সী ১২.৬% শিশু শিশুশ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সংখ্যার হিসেবে এটি প্রায় ৪৭ লক্ষ। তাই এই অতি গুরুত্বপূর্ণ পর্বটি আমাদের সমাজে একটা কার্যকরী সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যম হতে পারত।
তবে বর্তমানে মীনা খুবই কঠিন পরিস্থিতিতে আছে। দর্শক সংকটে বিপর্যস্ত বিটিভির পর্দায় মীনার কার্যকারিতা এখন কতটুকু এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসমীচীন নয়।
হয়তো এ কারণেই ইউনিসেফ বাংলাদেশ ফেসবুক পেইজ এবং ইউটিউব চ্যানেলকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমেও কী বার্তাগুলো ব্যাপকভাবে মানুষের ভিতর ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে? এই প্রশ্নটির উত্তর সোজা সাপটা, না, কখনোই হবে না। বিশেষ করে শিশুদের কাছে তো এগুলো ব্যাপকভাবে পৌঁছাবেই না। সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হবে, মীনা কার্টুনের পর্বগুলো বিটিভির পাশাপাশি বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচার করার ব্যবস্থা করা। এ কাজটি করতে সমর্থ হলে, ইউনিসেফ আবারও বাংলাদেশে মীনার বিস্তার ঘটাতে সমর্থ হবে। এদেশের শিশুরাও ফিরে পাবে তাদের প্রিয় মীনাকে।
অবশ্য মীনাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে ইউনিসেফকে বর্তমানে একটি নতুন পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। সেটি হল মীনা গেইম। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মীনা গেইম এন্ড্রোয়েড এবং আইওএস মাধ্যমে মুক্তি পায়।