অনেকক্ষণ হয়ে গেল।
চারটা নেদি পুড়ে গেছে এর মধ্যে। আর দুটো তল্লাবাঁশের মুড়ো।
বলক দিয়ে উঠেছে ভাত। পাশের চুলোয় সারকচু। সিদ্ধ হয়ে গেছে। নামাতে হবে। খোসা ছাড়াতে হবে। কচু দিয়ে শিং দিয়ে ঝোল হবে। মাছগুলো ভাজা হয়নি এখনো। মসলা বাটা হয়নি। অনেক কাজ বাকি।
কিন্তু এসবে খেয়াল নেই রাবেয়ার। ঘুলঘুলিতে ছোট্ট একটা বোতল। বিষের। মনোযোগ তার ওই দিকে।
ঠিক করতে পারছে না কিসে ঢালবে ওটা। ভাতে। নাকি তরকারিতে।
চিন্তার বিষয় আরও আছে। অনেক আগের জিনিস। পড়ে ছিল। পড়ে থাকলে সবকিছুতেই জং ধরে। এর ক্ষমতাও গেছে হয়তো। কাজ হবে কি না—নিশ্চিত হতে পারছে না। একটু চেখে দেখবে না কি? ভাবলো।
তখনই ঘরে ঢুকলো মেজেবু। বসলো পাশে।
রি-রি করে উঠলো দেহটা রাবেয়ার। বিষিয়ে উঠলো মন।
মেজেবু তার দুচোখের বিষ। সহ্য হয় না।
লোকে যদিও দেবীর মতো মানে।
নাম মেজেবুর যাহেদা বেগম। একনামেই চেনে সবাই। এলাকায় প্রভাব প্রচণ্ড। কারণও আছে। দুই-দশ গ্রামে জুড়ি নেই তার। কি কথায় কি বার্তায়, কি অর্থে কি দানে সে-ই সেরা। পড়াশোনায়ও তাই ছিল। এলাকার প্রথম মেয়ে হিসেবে ম্যট্রিক পাস। ফার্স্ট ডিভিশনে। তাও আবার বিজ্ঞান বিভাগে। তারপরই দাঁড়ি। পড়াশোনা শেষ। বাবা মারা গেলেন ভাইবোনগুলো ছোট। জমিজমা ছিল না। দেখার কেউ নেই। নিজেও সে ছোটই। তবু, বড় বলতে সে-ই। চাকরি জুটাতে হয়েছে তাই। পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মীর চাকরি। বেতন কম। প্রায়ই তাই মন খারাপ হয়। কিন্তু চাকরিটা সরকারি। তাছাড়া এ-ই তো ভরসা হয়ে ছিল সেই দুর্দিনে। এর জোরেই তো এসেছে এতটা দূর। নিজেকেই নয় শুধু, টেনেছে অন্যদেরও। ছোট দুটোকে পড়িয়েছে। মাকে নিয়ে রেখেছে নিজের কাছে। বিয়ের পর যদিও কঠিন হয়ে গেছে সব। স্বামীসন্তান আছে। একজনের ঘর করে অন্য ঘর দেখার জ্বালা অনেক। তবু। সে-ই ছায়া সবার ওপর। সব কাজেই তার সিদ্ধান্ত মানা হয়। বলতে গেলে মেজেবুই এ বাড়ির বড় ছেলে। দিনে দুর্দিনে প্রতিবেশীদেরও ভরসা সে।
সবাই তাই মেনে চলে তাকে। গাড়োয়ান গরু লাঠিধরা চালককে যেমন মানে।
অমন করে মানতো না রাবেয়া। মানতো গুরুজন হিসেবে। শ্রদ্ধা করতো। ভয় পেতো। ভালোও বাসতো। কিন্তু সেসব এখন অতীত। এখন তাকে ঘৃণাই করে সে। ডাহা ঘৃণা।
কারণ জানতে হলে একটু পিছিয়ে যেতে হয়। বছর চারেক আগে।
খুব অসুখ করেছিলো ময়নার।
পাতলা পায়খানা। আর রক্তবমি। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। চোখ যেন বেরিয়ে আসছিল শ্বাসপ্রশ্বাসের সময়। নেতিয়ে পড়েছিল মেয়েটা। রাবেয়া মা। তার শক্ত থাকা দরকার। কিন্তু ভেঙে পড়েছিল সে। কাঁদছিল পাড়া জাগিয়ে।
ছোট একটা পাপ করেছিল। মনে পড়ছিল সেটা। মনে হচ্ছিল সব ওই পাপের ফল। আর কখনো অমন করবে না। কোনো অন্যায়ই আর করবে না। কারও হক মারবে না। কষ্ট দেবে না কাওকে। প্রতিজ্ঞা করছিল।
সবকিছু দিয়ে হলেও মেয়েটাকে বাঁচাতে চায়ছিল সে। দুনিয়ার কিছুই তো মেয়েটা দেখল না। পইশ পড়লে ছয় বছরে পা দেবে। কি ছটফটে নাদুস নুদুস ফুটফুটে মেয়ে! টনটন করে কথা বলে! তাকে কেন মরতে হবে? এ কেমন বিচার? নেওয়ার মতো মানুষের কি অভাব? নিতেই যদি হয়, আল্লা যেন তাকে নেয়।
মায়ের মন! হু হু করছিল।
কী করলে আল্লা রেখে যাবে মেয়েটাকে? যে যা বলেছে, সব করেছে। চেষ্টার কোনো খামতি রাখেনি সে।
দবিরদ্দির কাছে গিয়েছে। কবিরাজিতে খ্যাতি আছে তার। হাত ভালো।
বজলু ডাক্তারকে দেখিয়েছে। যদিও হোমিওপ্যাথির ওপর বিশ্বাস নেই। তবু। চেষ্টা তো করতে হবে।
বড় হুজুরের হাতে-পায়ে ধরেছে। খাসি মানত করে এসেছে। দুই জুম্মা মানুষ খাওয়াবে বলেও ঠিক করেছে।
পাড়ই পাড়ায় গেছে। মাঞ্জাবুড়ির কাছে। তার তাবিজে হাঁটকুড়োদের সন্তান হয়। দাউদের বউ তখন ছয় মাসের পোয়াতি। সে তো মাঞ্জাবুড়ির তাবিজ নিয়েই। মান্দার শেখের মেয়েটাও নাকি তার জোরেই হয়েছে। ওপাড়ার কহিবু বলেছিল কথাটা। বাচ্চাদের চুল দিয়ে তাবিজ বানায় বুড়ি। তাবিজে কাজ হলে যাদের চুল দিয়ে বানানো, তাদের কলেরা হয়। হলেই শেষ। মান্দার শেখের মেয়ে হওয়ার দুমাস আগেই যেমন চলে গেল সন্নতের ছেলেটা। কলেরায়।
ময়নার নামেও কেউ তাবিজ করল না তো! শত্রুর তো তার অভাব নেই! মনে হতেই পা বাড়িয়েছিল।
ঠেসে ধরেছিল বুড়িকে। বুড়ি তো অবাক! বারবার বলেছে অমন তাবিজ সে বানায় না। কিরে কেটেছে। দিব্যি দিয়েছে ভগবানের নামে। বিশ্বাস হয়নি রাবেয়ার। ক্ষান্ত হয়নি সে। পড়েই ছিল পা ধরে। সকালের রোদ মাথায় উঠলো। গড়িয়ে গেল। লম্বা হলো ছায়া। তবু উঠলো না রাবেয়া। পড়েই থাকতো হয়তো। জোর করে বাড়ি এনেছিল খালেক ব্যাপারি।
পরদিন বেড়ে গেল অসুখ। মেয়ে কোলে তাই বসে ছিল রাবেয়া। সারাদিন। উঠেছিল বিকেলে। আসরের সময়।
এমনিতে নামাজ পড়ে না। কিন্তু তখনকার কথা আলাদা। সেজদায় চোখ ভাসাচ্ছিল বারবার। লোনাজলেও যদি ভেসে যায় অসুখটা!
শোয়ার ঘরটার সামনেই রান্নাঘর। মাঝখানে এক চিলতে উঠোন। উঠোনের কোণে আমড়াগাছ। পাশে শিউলি। কি সুন্দর ফুল হয়! রূপ দেখতে হয় ভোরে। আবছা আলোয়। লাল সাদা নকশা এঁকে পড়ে থাকে ফুলগুলো। কালচে মাটির ওপর। মনে হয় জাফরান দেওয়া বাসমতি চালের ভাত। ছড়ানো। কী সুবাস! ম ম করে চারপাশ। ছুটে আসে ময়না। ছোট্ট ফ্রকের কোল ভরে যায় ফুলের আহ্লাদে। সে ফুল পাশাপাশি বসে। শোয়। দাঁড়ায়। এক সুতোয়। মালা হয়। তারপর চুড়ি হয়। জড়িয়ে যায় মা-বাবার হাতে।
ঘুম ভাঙতেই দ্বিধায় পড়ে রাবেয়া। কার রূপ দেখবে! শিউলির, না কি ময়নার? দেখতে দেখতে আত্মহারা হয় সে। ছোটবেলার স্মৃতি জাগে। সেও ঘুম ভাঙাতো মা’র। ওভাবেই। কুড়িয়ে আনতো ফুল। সজনের। কুমড়োর। বকুলের। শিউলির।
সেই বিরহী বিকেলে নড়ে উঠেছিলো ভোরগুলো তার। শিশির জমেছিলো চোখে।
অজু করছিল সে।
বুড়িয়ে গেছে কলটা। শ্যাওলা জমেছে গোড়ায়। গলায়। বুকে। আর হাতলে। হাতলটা ধরার জায়গাতেই শুধু ফর্সা। চকচকে। তাই পিছল। জোরে চাপা যায় না। পিছলে যায়। ঠিকমতো চাপতেও পারে না ময়না। তাই ওপরে তুলেই ঝুলে পড়ে তাতে। বাদুড় ঝোলার মতো। হাসি পায় দেখলে। ভালোও লাগে। বোঝা যায় বুদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু আর বাড়বে তো?
কলপাড়ে গ্যান্দা ফুলের গাছ। প্রতিদিন একটা করে ফুল ছিঁড়ে ময়না। মাথায় গোঁজে। আচ্ছা, ফুলগুলো সব কই? ফাঁকা যে গাছটা! মোচড় দিয়ে উঠেছিল বুকটা। ঝাপসা চোখ পড়ে ছিলে ফুলহীন ডালে। তার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছিল পথ। কুমড়োর মতো একটা দেহ দুল ছিল সেখানে। মেজেবু। চিনতেই আগুন জ্বলেছিল গায়। সেই প্রথম। লাফ দিয়ে উঠেছিল রাবেয়া
তেড়ে গিয়েছিল। মারবে। কিন্তু ধরে ফেলেছিল লোকজন। মুখটা তাতে বন্ধ হয়নি।
ডাইনী বুড়ি! একেনে আইচিস ক্যান? তোর জন্যিই এই অবস্তা আজ। তুই আমার সামনেত্তে যা। ওই অলুক্কুনে মুক যেন আমি না দেকি। রাক্ষুসী! আমার মা’র কাচে যাবিনে তুই খবদ্দার। ওর কিচু হলি, তোরে ছেড়ে দোবো মনে করিচিস? না। তোর বংশও নিব্বংশ করে ছাড়বো। খানকি। মাগি। তোর জন্যিই এই অবস্তা আমার।
তার তখন গলা বসা। কষ্ট হচ্ছিল কথা বলতে। তবু থামেনি।
প্রচুর লোক দেখতে এসেছিল ময়নাকে। চারপাশে ভিড়। তাদের কারও কাছেই অজানা ছিল না বিষয়টা। তবু ব্যাখ্যা করেছিল রাবেয়া। বুঝিয়েছিলো দায়টা মেজেবুরই।
সেজন্য তাকে ফিরতে হয়েছিল অতীতে। তিন বসন্ত আগের এক বর্ষায়। যখন জন্ম হলো বিউটির।
যে সময়ের কথা হচ্ছে, তখন মেয়ে হলে খুশি হওয়ার চল ছিল না।
তবে খালেক ব্যাপারী মন খারাপ করেনি। মন খারাপ ছিল রাবেয়ার। ছেলের খুব শখ তার স্বামীর। অথচ এবারও ছেলে জন্মাতে পারল না সে। দোয়া করছিল তাই। আল্লা যেন পরেরটা তার ছেলেই দেন।
কিন্তু গোল বাধালো মেজেবু। বলেছে আর কোনো সন্তান না। ছোট পরিবার সুখী পরিবার। দুটো সন্তানই যথেষ্ট।
কথাটা কানে তোলেনি রাবেয়া। ছেলে না থাকলে আবার কিসের সুখ?
ঠিকইতো। বুড়ো বয়সে ছেলের ভাত খাবে—এ লোভ নেই। সে আশা করেও না সে। তাছাড়া অনেক তো দেখলো, কটা ছেলে বাপমাকে দেখে? মুলো মোটা হলেই ভোল পাল্টায়। ভুলে যায়। তার ছেলে হলিও যাবে। এ রাবেয়া ঠিকই জানতো। কিন্তু সংসারটা তো সে-ই টিকিয়ে রাখবে! মেয়ে তো বিয়ে হলেই পর। ছেলের স্বপ্ন তাই দেখতেই থাকে সে। চলতে থাকে আরাধনা। যত যা-ই হোক, সন্তান সে নেবেই।
এরপর একদিন। নতুন কথা আনে মেজেবু।
দিনকে দিন মানুষ বাড়ছে। যত মানুষ তত মুখ। তত খিদে। তত খরচ। মানুষ বেশি তো সমস্যা বেশি। এমনিই দেশটা গরীব। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। মানুষের ভার বাড়লি তো আর কথাই নেই। চলা দায় হবে। উন্নতি করতি পারবে না। সরকার তাই মানুষ কমাতি চায়।
ভয় পেয়েছিল রাবেয়া। তবে কি মানুষ মারবে ধরে ধরে!
না। মানুষ নিয়েই তো সরকারের কাজ। তাদের মেরে ফেললি কি চলে! বুঝিয়ে বলে মেজেবু।
যা হওয়ার হয়েচে। আর যেনো না হয় সেই ব্যবস্থা নিতি হবে। বিশেষ করে যাদের দুটোর বেশি সন্তান আছে তাদের।
এ আবার হয় নাকি?
হয়। সেটাই করছে সরকার। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। একবারের গেঁরো। চিরদিনের মুক্তি।
শুদু শুদু টাকা খরচ..
না না। টাকা লাগবে না। ঝামেলা সব সরকারের।
বুঝিয়ে দেয় মেজেবু। কিভাবে কী করা হবে। কোথায় যেতে হবে। বলে।
ক’দিন ধরে শুনছিল এ-ও পেট কাটাচ্ছে। মেজেবু তাহলে পেট কাটার কথাই বলছে। না, সে পেট কাটবে না।
কিন্তু পিছু ছাড়ে না মেজেবু। ভাই ভাবি দুজনকে নিয়েই বসে এক রাতে।
শীতশুরুর রাতটা সেরাতে ভেসে ছিল কুয়াশায়। গলে পড়ছিল মস্ত গোল চাঁদ। জোছনায় মিশছিল কুয়াশাধোয়া আঁধার। আর আঁধারঘেরা কুয়াশা। সব ধোয়া ধোয়া। দেখা যাচ্ছিল না ওপাশের পুকুরটা। নিশ্চয় নিথর পড়ে ছিল তার পানাজমা পানি। তাতে নিশ্চয় তিরতির কাঁপছিল রাতজাগা পোকা। হালকা বাতাস ছিল। নিশ্চয় কাঁপছিল পুকুরপাড়ের বনডুমুরের গাঢ় সবুজ পাতা। তাদের খসখস গলাসাধা শুনছিল রাবেয়া। খোলা জানালায় বসেছিল সে। কিন্তু দেখছিল না কিছুই। নিবুনিবু চোখ যদিও পড়ে ছিল ওদিকেই। সারাদিনের ক্লান্তি ঠেসে ধরছিল পাতাদুটোকে। লেগে আসছিল তারা। তাই ঢুলে ঢুলে পড়ছিল। আর চমকে চমকে উঠছিল। আর শুনছিল মেজেবুর কথা। মনে আছে।
আমি কি তোদের পর? কতা শুনিসনে ক্যান তুরা? মানুষ হতি পাল্লি মেয়েরা ছেলেদের চে’ কম কিসি? ওই ময়না আর বিউটিই ছেলের কাজ করবে। আমার মতো। মেয়ে হয়েও তো তোদের দেকচি। ছোট দুটোরে কাচে রেকে পড়াচ্চি। কোনো বড়ভাইও তো আজকাল এরাম করে না। মেয়ে হইচি বলেই কি পচে গিচি? তাছাড়া পরের বাচ্চাডা যে ছেলেই হবে, সেইটার কোনো গিরান্টি আচে? এবং ঘরের লোক কথা না শুনলে, পরকে সে বোঝাবে কী করে? কথা ঠিক। এর পরে আর কথা থাকে না। কাশেম ময়রার কথাও মনে পড়ে। চার মেয়ে লোকটার। ছেলের আশায় আরেকটা হয়েছে। এটাও মেয়ে! সব ভেবে রাজি হয় ব্যাপারী। মন মানছিল না রাবেয়ার। কী হয় না হয়। ঘাড়টা তবু নাড়িয়েছে। স্বামীর কথার অবাধ্য সে হয় না।
পরের সপ্তায় পেট কাটা হলো তার। নুরির মা, রুকির মা আর তায়রা বুও কাটালো একসঙ্গে।
যতটা ভেবেছিল, কষ্ট ততটা হয়নি। সময়ও লাগেনি বেশি। আসার সময় আবার উপহারও দিয়েছে ক্লিনিক থেকে।
একটা করে শাড়ি। গজা মুড়ি। আর দু’শ টাকা।
শাড়িগুলোর মধ্যে রাবেয়ারটাই বেশি সুন্দর। দেখেই মনে হচ্ছে দামি। পছন্দ হয়েছে খুব। এটা হবে তার তোলা শাড়ি। এখানে সেখানে যাবার সময় পরবে। আরও আরও কথা চলে আসে শাড়িটার পাড় বেয়ে। চলে আসে স্বপ্ন। চলে আসে গল্প।
গল্পমুখেই বাড়ি ফেরে ওরা। পেটকাটা মানুষের দল।
তারপর মাঝে মাঝে মনে পড়ে। পেটের কথা।
তারপর কম কম। তারপর আর পড়েই না। ঘটনাটা ভুলেই গিয়েছিল তারা। পেট যে তাদের কাটা, মনে পড়লো এক সন্ধ্যায়। বিউটির বয়স তখন দুই।
রাজহাঁসের পাল ঘরে ফেরেনি। ময়নাকে নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছিল রাবেয়া। ফিরে এসে দেখে তার বিউটি আর নেই। ঘুমিয়ে ছিল বারান্দায়। পড়ে গেছে। মাথায় আঘাত লেগেছিল হয়তো।
তখন থেকেই আতঙ্কটা পেয়ে বসে রাবেয়াকে। বড়টারও যদি কিছু হয়! কি নিয়ে বাঁচবে সে?
সারাক্ষণ তাই আগলে রাখে ময়নাকে। চোখের আড়াল হতে দেয় না। কাজ করায় না। বাড়ির কাছেই স্কুল। সকালে দিয়ে আসে। ছুটি হলে নিয়েও আসে। কাউকে ঘেঁষতে দেয় না কাছে, পাছে চুল কাটে! মাঞ্জাবুড়ির তো এমুখো হওয়াই নিষেধ।
কিন্তু শেষরক্ষা হলো কই?
এ কি অভিশাপ? নাকি কপালের দোষ?
থামেনা রাবেয়া। বলেই চলে।
দুদিনের নাখাওয়া গা। জোর কম। তাই থামতে হয়। চুপসময়টুকুতে ভাবনারা সুর তোলে। নানা রঙ নানা ঢঙের ভাবনা সেসব। সমস্যার। সম্ভাবনার। শঙ্কার।
মুখবুজে সব শুনছিল মেজেবু। বুক ছিঁড়ে যাচ্ছিল তারও। কিন্তু কথা আসছিল না। কী-ই বা বলার ছিল তার? কে জানতো এমন হবে? আরও শতেক মহিলার পেট কাটিয়েছে সে। সবাই দিব্যি আছে। ওই তো নুরির মা আর তায়রা বু দাঁড়ানো। ওদেরও তো অভিযোগ নেই। দোষটা তাই খুঁজে পাচ্ছিল না মেজেবু। তবু অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজেকে। কারও দিকে তাকাতে পারছিল না।
বসে ছিল একা। বড় আমগাছটার নিচে। সারাবাড়ি তার ছায়া পড়ে। কিন্তু ডালগুলো নরম খুব। গেলো সপ্তায় ভেঙেছিল একটা। পড়েছিল মেজেভাইর ছেলেটার ঘাড়ে। তাই নিয়ে তুমুল কাণ্ড। কেটেই ফেলবে গাছটা ওরা। মেজেবুই থামিয়েছিল এসে।
আজ যদি একটা পড়তো! তার মাথায়! ভালো হতো। মনে হচ্ছিল তার।
শরৎ শেষের সন্ধ্যা ছিল সেটা। আঁধার ঘন হচ্ছিল। মৃদু হাওয়া বইছিল। ভালো লাগার একটা আবহ। কিন্তু এ বাড়ির তখন মনখারাপ। বিষণ্নতা আঁকা চারপাশে। আতঙ্ক ছড়ানো প্রতিটি কোণায়।
লম্প জ্বালিয়েছিলো কে যেন। চুপ করে বসে ছিল টিনের কৌটোটা। পেট ভরা তার কেরোসিন। তাতে ভিজে সজীব হয়েছে একটুকরো কাপড়। উঠে গেছে গলা দিয়ে। তারপর মাথা তুলেছে বাতাসে। সেইখানটায় আগুন। জ্বলছে। টিম টিম। ভয়ে কাঁপা বাচ্চার মতো কাঁপছিল। আঁধার তাতে কাটেনি। কাঁপা আলোয় চাপা আঁধার মিশে রহস্য গড়ছিল শুধু। তবু হাল ছাড়েনি পিদিমটা। তাই নেভেনি। নেভেনি ময়নাও। জেগে উঠেছিল ভোরে। সূর্যের মতো। জ্বলেছিল আরও অনেক দিন। তারপর নিভে গিয়েছিল এক দুপুরে। হঠাৎ। এইতো সেদিনের ঘটনা।
খুব বৃষ্টি ছিল। ভিজছিল মেয়েটা। ভিজতে ভিজতেই গিয়েছিল বাঁওড়ে। একা। সেখানেই ঘটেছিল ঘটনাটা। কিন্তু কিছুই জানতে চায়নি রাবেয়া। শুধু শুনেছে তার সোনাপাখিটা আর নেই। নেই তার ভাঙাদিনগুলো শিউলিমালায় বেঁধে দেওয়ার কেউ। নেই কলের হাতল ধরে ঝুলে ঝুলে এক এক জগ পানি এনে দেওয়ার কেউ। নেই তার ঘাম মোছার ছোট্ট কোমল হাতদুটো। আর নেই আতঙ্কটা। ময়নার যদি কিছু হয়! কিছু হলো নাকি মেয়েটার! চমকে চমকে ভাবতে হয় না আর। ভাবতে হয় অন্যকিছু। কী হবে তার! কোথায় যাবে। সবকিছু বদলে গেছে। দিন রাত। নাওয়া খাওয়া। ওঠাবোস। আর ব্যাপারি! সব দোষ সে রাবেয়ার ওপর চাপায়। রাবেয়াই নাকি পেট কাটাতে হন্যে হয়ে ছিল। বলে বেড়ায়। অলুক্ষুণে হাঁটকুড়ে বউ ঘরে রেখে কী করবে? পুজো দেবে? না। পূজো সে দেয়ওনি। রাবেয়ার জায়গা হয়েছে রান্নাঘরের মেঝেয়। ব্যাপারি থাকে বড়ঘরে। নতুন বউ নিয়ে। দুমাস না যেতেই বমি করা শুরু করেছে মাগীটা। তারপর থেকেই সুর বদলেছে ব্যাপারি। দুই বউ টানতে পারবে না সে। তালাক দেবে বড়টাকে।
বুক ছিঁড়ে যায় রাবেয়ার। কী না করেছে সে এই সংসারে! কী ছিলো খালেক ব্যাপারির? জিজ্ঞেস করো প্রতিবেশীদের। ওরা জানে। তিল তিল করে সে-ই তো গড়েছে সব। লোকে শুধু বিটাছেলের কষ্ট বোঝে। মেয়েলোকের ঘাম কি কেউ দেখে? তাকে যে সবাই হাঁড়কিপটে বলে, কেন? কেন সে এত ছোট করে মাছ কাটে? লোকে ব্যঙ্গ করে। বলে আঙুল কাটেনি তো! কেন? চাইলেই সে ভালো খেতে পারে। পরতে পারে। মাখতে পারে। চায় না কেন? ব্যাপারির জন্য। সবটুকু সম্মান সে বিসর্জন দিয়েছে তার কারণে। সবটুকু ঘাম সে ঝরিয়েছে এই সংসারে। বাপ ঠিকই বলেছিল। ব্যাপারিরা জাত ভালো না। নিষেধ করেছিল আসতে। শোনেনি রাবেয়া। চলে এসেছিল। বাপটা যখন চলে গেল, চোখের দেখাও দেখতে পায়নি। এই যে মা’টা আজ মরোমরো। এই মরে এই বাঁচে। তাকেও তো দেখতে যেতে পারে না। দূরত্ব বেশি না। তবু যাওয়ার পথ নেই। মুখ নেই যাওয়ার! দুনিয়াকে সে পর করেছে যার জন্য সে-ই যদি তাকে ফিরিয়ে দেয়, দিক। একটাই তো পেট, ঠিক চলে যাবে। তালাকের ভয় তাই করে না রাবেয়া। কিন্তু তার কলিজার টুকরাটা তার সোনা মানিকটা নেই যে! খা খা করে ভেতরটা। মোচড় দেয়। বাঁচতে ইচ্ছে করে না। তাই কিনেছিল বিষটুকু। খেয়েই ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু একা কেন মরবে সে? মেজেবুর কেন শাস্তি হবে না? মনে হয়েছিল। তাই রেখে দিয়েছিল যত্ন করে। সঙ্গে নেবে মেজেবুকেও। সবকিছু খুইয়েছে রাবেয়া। গিন্নিপনা। চাবির গোছা। চুলোর তাপ। সব এখন ছোটমাগীর হাতে। নিজেকে আপদ আপদ লাগে। রাণীর জীবন যার, বাঁদির বসন সয়না তার। তাই ঘেন্না হয় জীবনটার ওপর। প্রায়ই বিষ হাতে নেয় সে। আর রেখে দেয়। একসঙ্গে খাবে। দুজন। কিন্তু মেজেবুকে বাগে পাওয়া মুশকিল। ময়না মরার পর এ বাড়ি আসা কমিয়েছে মেজেবু। আসলেও রাত থাকে না।
আজ থেকেছে। ধলগাঁ মাঠে একটা জমি কিনবে সে। দেখতে হবে। তাই এসেছিল। উঠোন ছুঁতেই চিৎকার শুনেছিল রাবেয়ার। ব্যাপারি তখন পিটাচ্ছে তাকে। মুখ চালাচ্ছে সমানে। সে গালি শোনার মতো না। সে দৃশ্য দেখার মতো না। মেজেবুই থামিয়েছিল ভাইকে। তারপর বসেছিল দুজনকে নিয়ে। ব্যাপারি গোঁ ধরেছিল। রাবেয়াকে বের করে দেবে। তালাক দেবে। রাবেয়া বলছিল তার ঘর ছেড়ে সে যাবে না। দেখবে কতবড় বুকের পাটা ব্যাপারির। দিক তালাক। তাড়াক তাকে। শুনে ব্যাপারি আবার গিয়েছিল তেড়ে। এমন নাকি প্রায়ই হয়। প্রায়ই রক্ত ঝরে রাবেয়ার। এখানে থাকলে তো মরেই যাবে সে। বুঝেছিল মেজেবু। তাই ঘোষণা করেছিল রাবেয়াকে নিয়ে যাবে সে। তার ঘরভরা জিনিস। সারাদিন কাটে অফিসে। কাজের মেয়েদের দিয়ে বিশ্বাস নেই। গত সপ্তাহে পালিয়েছে একটা। তার এখন আপন কাউকে দরকার। নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। রাবেয়ারও একটা কিনারা হবে তাতে। প্রস্তাবটা ভালো। কিন্তু ফুঁসে উঠেছিল রাবেয়া। সে মরবে তবু ওই রাক্ষুসীর ঘরে যাবে না। রাগ করেনি মেজেবু। ঠাণ্ডামাথায় বুঝিয়েছে। রাজি হয়নি রাবেয়া। মাথাচাড়া দিয়েছিল পুরনো রাগ। সব ঘটেছে ওই পাষণ্ডটার জন্য। তার কারণেই আজ সন্তানহারা সে। নিজে ঠিকই পেট বাঁধিয়েছে! দোজখ জ্বলছিল বুকে। তা কি নিভবে তাকে না মারলে? ইচ্ছেটা তাই জোরদার হয়েছিল। সকালে ছোটবউ যখন উঠল না, তার শরীর খারাপ, রাবেয়াই গেলো চুলোর কাছে। ভাত-তরকারি চড়ালো। খুব চিন্তা হচ্ছিল তার। দোষ করেছে মেজেবু। কিন্তু তার পেটেরটা তো নিষ্পাপ। মেজেবুর জন্য তাকেও কি মারবে? নাকি তাকে বাঁচাতে ছেড়ে দেবে জল্লাদটাকে? চোখদুটো পড়ে ছিল বিষের বোতলে। বুকটা তখন তার পলাশীর প্রান্তর। যুদ্ধ চলছে হ্যাঁ আর না’র।
তখনই ঘরে ঢুকলো মেজেবু। শরীরটা তার মোটা। তার উপর পোয়াতি। কষ্ট হয়েছে বসতে। একটু দম নিয়েছে। তারপর কথা। রাবেয়ার কষ্ট সে বোঝে। কিন্তু কী করা যাবে। যা ঘটে তার ইশারা আসে ওপর থেকে। এতে কারও কারও হাত থাকে। কিন্তু কিছু করার থাকে না কারও। সে লজ্জ্বিত। কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার ভাষাও নেই তার। ততক্ষণে মাছ ভাজছে রাবেয়া। ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে উঠছে গরম তেল। তাতে পুড়ে লাল হয়ে কালছে হয়ে যাচ্ছে নরম কোমল শিংয়ের শরীর। মনে হচ্ছে তাকেই যেন ভাজছে কেউ। জ্বলছিল পুরো গা। মেজেবু বলেই গেছে। একতরফা। উত্তর পায়নি। একসময় তাই উঠে গেলো সে। তাড়া আছে তার। অনেক দূরের পথ। রওনা হতে হবে। গিয়ে বসে বারান্দায়। দুটো মুখে দেবে। তারপর যাবে। সেই সুযোগে গলা চড়ছিল হ্যাঁ। অমনি নেমে আসলো বিষটুকু। উপুড় হলো। মিশে গেলো ভাতে। রাবেয়ার গা কাঁপছে। পা কাঁপছে। বুক কাঁপছে। কিন্তু হাত কাঁপছে না। খাবার সাজালো মেজেবুর জন্য। গ্লাস জগ দিয়ে আসলো। তরকারির বাটি দিল। তঠাৎ তার হাতটা ধরলো মেজেবু। ধরে আসা কণ্ঠ। তাতে অনুনয়ের সুর।
ময়নার জন্য তার কি পোড়ে না? সে কি পাষাণ? এখনো যে একা একা চোখ মোছে সে।
তবু কথা বলে না রাবেয়া। আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নেয়। পা বাড়ায় রান্নাঘরের দিকে।
কথা থামায় না মেজেবু। আল্ট্রাসনো করেছে। ডাক্তার বলেছে মেয়ে হবে। সেই জন্যই রাবেয়াকে চায় সে। মেয়েটার নাম রাখবে ময়না। কিংবা বিউটি। কিংবা রাবেয়ার যা খুশি। মানুষ করবে দুজন মিলে। বুকের ভার তাতে একটু যদি কমে।
ধক করে ওঠে বুকটা রাবেয়ার। তাকায় মেজেবুর দিকে। চোখ চিকচিক। বুক ধড়ফড়। তবু বলে না কিছু। ফিরে যায় রান্নাঘরে।
সেখান থেকে শব্দ আসে। ঝনঝন। উল্টে গেছে ভাতের প্লেট। প্লেটটা মেজেবুর। সে এলেই বের করা হয়। অন্যসময় তোলা থাকে। রাবেয়ার চিৎকারও শোনা যায়। গালি দিয়ে ওঠে সে। বিড়াল তাড়ায়।
পুনশ্চ:
আসলে রাবেয়াই ফেলে ভাতটুকু। বিড়াল তাড়ানোটা অভিনয়। মিথ্যেটাকে সত্য প্রমাণের চেষ্টা। সচেতন পাঠকমাত্রই বুঝেছেন।
কিন্তু মেজোবুকে চেষ্টা করতে হয়নি। তার মিথ্যাগুলো সত্যের মতো। সত্য বলেই ধরে নেয় মানুষ। তাই ভুল করেছে রাবেয়া। তার মনে হয়েছে সত্যিই মেজেবু পোয়াতি। তার মেয়ে হবে। তার নাম রাখা হবে ময়না। কিংবা বিউটি। কিংবা রাবেয়ার যা খুশি।