শাহ আলম মল্লিক আজও কাসেমের দোকানে এসেছে।
কাসেম বলেছে আজ হিসাব করে টাকাটা দিয়ে দেবে। গত তেইশ দিনে আজ নিয়ে কাসেমের দোকানে তিনবার আসা তার। আগে একবার বলেছে হিসাব করা হয় নাই। আরেকবার বলেছে টাকা হাতে নাই। এর পরে বলেছে আসলে হিসাবই করা হয় নাই। আজ যদি না দেয়, তাহলে আর আসবেই না। মনে মনে ভাবলেও ভেতর থেকে সমর্থন আসে না। আসতেই হবে তাকে। ছেলের পাওনা টাকা। এখানে কাজ করেছে। ন্যায্য পাওনা ছাড়বে কেন? আর ছাড়লেই তাকে কে টাকা দিয়ে সাহায্য করবে?
কাসেম কি দেখছে না শাহ আলম মল্লিক অন্ধ মানুষ? লাঠি ঠুকে ঠুকে সেই সাত মাইল দূরের মিজিকান্দি থেকে আসে! কয়েক মাইল হেঁটে আসার পরে ট্রলারে উঠে হাটের এই দোকানে আসতে হয়। ট্রলারে ওঠার সময় কারও সাহায্য নিতে হয়। কয়েক শ বছরের পুরনো এই হাট এখন আর হাট নাই। স্থায়ী বাজার হয়ে গেছে। শুধু সপ্তাহে দুটি দিন কতগুলো আলগা দোকান বসে। এ ছাড়া সবই স্থায়ী দোকান। দোতলা মার্কেটও আছে কয়েকটা।
শাহ আলম মল্লিকের ছেলে আরিফ মল্লিক এ দোকানে কাজ করত। ছোটবেলাই সে কাজ শিখেছে। বাইশ বছর বয়সে সে প্যান্ট-কোট-স্যুট-সাফারিও বানাতে পারত। এখানকার দোকানে কেউ অবশ্য কোট-স্যুট বানাতে দিতে চাইত না। সবাই ঢাকা থেকে বানিয়ে এনে দিতে বলত। আরিফ এলিফ্যান্ট রোড থেকে বানিয়ে আনার কথা বলে গোপনে নিজেই বানাত। বাড়িতেও তার মেশিন আছে।
বাইশ বছর বয়সের জোয়ান ছেলে কত কাজ করত। টাকাও বেশ কামাই করত। বাড়িতে না জানালে কী হবে! শাহ আলম মল্লিক চোখে দেখতে পান না। বাংলাদেশে নাকি হাজার টাকার নোট চালু হয়েছে; তিনি জানেন না সেটা কেমন। পাঁচশ টাকার আগের নোট চালু থাকতে থাকতেই তার চোখের দৃষ্টি কমতে শুরু করে। যতদিন ঝাঁপসা দেখতেন, ততদিন নতুন পাঁচশ টাকার নোট চালু হয়েছে। সেটা আবছা দেখতেন। যখন হাজার টাকার নোট চালু হয়েছে, তখন তার চোখ পুরাই আন্ধার হয়ে গেছে।
আজ হয়তো কয়েকটা হাজার টাকার নোট হাতে পাবেন। আরিফ মারা যাওয়ার আগে যেন কেমন করে কথা বলত। রেগেমেগে যেত। কিছু জানতে চাইলে উত্তর দিত না। শেষের দিনগুলোতে সংসারে নিয়মিত টাকা দিত না। ওর মা টাকা চাইলে বলত, মহাজনের কাছে টাকা আটকে আছে। মহাজনের কী যেন সমস্যা তাই কয়েক মাস টাকা দিতে পারবে না। যেদিন পোলা বিষ খেলো, সেদিন জানা গেল যে, আরিফ কলেজে পড়ুয়া কোনো এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। মেয়েটার জন্যই সে মারা যাওয়ার আগে এমন হয়ে গেছিল। বিষ খাওয়া পোলার লাশ নিয়ে অন্ধ মানুষ শাহ আলম মল্লিক থানা-হাসপাতাল করে অনেক ঝামেলা সয়েছেন। একটু কান্নার সময় পায় নাই। সবাই বলেছে আত্মহত্যা করা ছেলের জন্য কাঁদলে কবিরা গুনাহ হয়। আসলে তার কান্নার সুযোগই হয় নাই। চার দিনে মিলাদ পড়ানোর পরে চারজন গরিব-মিসকিনকে চারটা ডাল-ভাত খাওয়াতে পারেনি। ভেবে রেখেছে চল্লিশ দিনে করবে। যদি ট্রেইলারের মালিক কাসেম হিসাব করে টাকাটা বুঝিয়ে দেয়।
কাসেম তাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে ব্যস্ততা দেখিয়ে অবশেষে হিসাব নিয়ে বসল। শাহ আলম মল্লিক ক্যালকুলেটরের হিসাবের শব্দ শুনতে পেলেন। ভাবলেন কয়েক হাজার টাকা হলে জীবনের শেষ অপরাধে অপরাধী ছেলেটার জন্য মিলাদ দিয়ে আল্লাহর কাছে কেঁদে ক্ষমা চাইবেন। হাশরের ময়দানে যেন আল্লাহ ছেলেটারে ক্ষমা করে দেন। না হলে অনন্তকাল ছেলেটা অপরাধী হয়ে থাকবে।
শাহ আলম মল্লিক ভাবেন, সারা জীবনে তার ছেলে কারও সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটিও করে নাই। সবাই বলে চরাঞ্চলের মানুষ বড় খারাপ; মারামারি কাটাকাটি নিয়ে লেগেই থাকে। আর থানায় মামলা চলতেই থাকে। কিছু লোকে বলে চরের লোকেরা মারামারি না করলে সদরের ডাক্তাররা আর জজকোর্টের উকিলরা না খেয়ে মরত। কিন্তু শাহ আলম মল্লিকের ছেলে কোনোদিন কারও সঙ্গে ঝগড়াও করে নাই। ঘরের কারও সঙ্গেও না। কী জানি আল্লাহ কি ভালো মানুষদের কম আয়ু দিয়া দুনিয়ায় পাঠায়! না হলে তার ছেলে কেন অশিক্ষিত মানুষ হয়ে কলেজের মাইয়ার লগে প্রেম করবে? কলেজে পড়া মাইয়া কি ওর কাছে বিয়া দেবে?
আরিফ নাকি মেয়েটারে বলত, ‘দ্যাখো আমি অশিক্ষিত মানুষ, তোমার সাথে যাই না। তুমি শিক্ষিত ছেলেকে বিয়া করতে পারো।’
মেয়েটা নাকি বলত, ‘তুমি কি দেখো না এই দেশে কত অশিক্ষিত ছেলে শিক্ষিত মেয়ে বিয়া করছে। সংসার চালাতে যা লাগে তা জোগাড় করতে পারলেই হয়।’
মেয়েটা মিথ্যা বলেনি। এদেশে অহরহ এমন ঘটছে। সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া থেকে ফিরে আসা পঁয়তাল্লিশ বছরের অশিক্ষিত বুড়োও এইচএসসি পাস সুন্দরী বা অনার্স পাস মেয়ে বিয়ে করছে। সেই ভরসায় আরিফ এগিয়ে ছিল। টাকা সঞ্চয় করত পরে বিদেশে গিয়ে কিছু টাকা করার জন্য। মেয়েটাকে নিয়ে সংসার করতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্পর্ক গভীর হওয়ার পরে মেয়েটি ঘুরে গিয়েছিল। তখন সে উল্টা কথা বলেছে, ‘তোমার সাথে আমার যায় না।’
হিসাব-নিকাশ করে কাসেম পঁয়তিরিশ টাকা শাহ আলম মল্লিকের হাতে দিয়ে বলল, ‘চাচা, আপনের পোলা তো টাকা আমার কাছে বেশি পাইত না। সপ্তার টেকা সপ্তাহেই নিয়া নিছে। শুধু মারা যাওয়ার আগের দিন একটা লুঙ্গি সিলাইছে আর জানি কী ছোটখাটো কাজ করছে। হিসাব কইরা দেখলাম এই একতিরিশ টেকা পাইব। আমি পুরা পাঁয়তিরিশই দিলাম।’
শাহ আলম মল্লিক জোয়ান ছেলের মরণেও এমন ধাক্কা খায় নাই। মুখে কোনো কথা নাই তার। কাঁপা হাতে টাকাগুলো নিয়ে ট্রলারে গিয়ে উঠলেন। ওঠার সময় পাগুলোও তার কাঁপছিল। একজনে তাকে ধরে উঠিয়েছে। আল্লাহর কাছে কোনো অভিযোগ-অনুযোগ করেছে কিনা ইঞ্জিনের শব্দে কেউ বুঝতে পারে নাই।
ট্রলার ঘাট থেকে নেমে গ্রামের রাস্তা দিয়ে লাঠি ঠুকে ঠুকে হাঁটতে লাগলো। ফকির বাড়ির কাছে রাস্তার পাশে বাঁশঝাড়। কঞ্চিগুলো রাস্তায় এসে পড়েছে। ধারালো পাতা মুখে এসে লাগে। বাঁশপাতার গন্ধটা নাকে লাগতেই শাহ আলম মল্লিকের মনে পড়ে গেল সেদিনের সেই গন্ধের কথা। গোরস্থানে শুধু বাঁশপাতার গন্ধ। সেখানে যত কবর, সবগুলোতেই বাঁশপাতার গন্ধ। দুপুরের এ সময় রাস্তাটা প্রায় নির্জন। হঠাৎ বসে পড়ল। আর হাঁটতে পারছে না। একটু পরে বলে উঠলো, ‘বাবা, বাবারে, তুই এই আন্ধা বাপটারে কেন লইয়া গেলি না। বাবা, কোন দোষে আমারে এমুন শাস্তি দিলি বাবা। আমি অচল মানুষ আমারে পথে থুইয়া গেলি! বাবা!’
মন্তব্য